০৫:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
উচ্চ মাধ্যমিকে ফল বিপর্যয়

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ২১ বছরের সর্বনিম্ন পাসের হার: পতন পাসে, তলানিতে জিপিএ-৫

সাম্প্রতিক উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার রেকর্ড করা হয়েছে। এবারের ফলাফলে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ব্যাপকহারে কমে যাওয়ায় শিক্ষা মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর বকশি বাজারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন। প্রকাশিত ফলাফলের প্রধান দিকগুলো নিম্নরূপ:

পরীক্ষার ধরন পাসের হার জিপিএ-৫ প্রাপ্তি
এইচএসসি ও সমমান ৫৮.৮৩ শতাংশ ৬৯,০৯৭ জন
শুধুমাত্র এইচএসসি ৫৭.১২ শতাংশ ৬৩,২১৯ জন
আলিম (মাদরাসা) ৭৫.৬১ শতাংশ ৪,২৬৮ জন
কারিগরি ৬২.৬৭ শতাংশ ১,৬১০ জন

গত বছরের তুলনায় ফলাফল পতন:

সূচক পতনের পরিমাণ
পাসের হার হ্রাস ১৯.২৫ শতাংশ
জিপিএ-৫ প্রাপ্তি হ্রাস ৭৬,৮১৪ জন

বোর্ডভিত্তিক ফলাফলের তুলনামূলক চিত্র:

বোর্ড পাসের হার জিপিএ-৫ প্রাপ্তি
ঢাকা ৬৪.৬২% ২৬,০৬৩ জন
রাজশাহী ৫৯.৪০% ১০,১৩৭ জন
বরিশাল ৬২.৫৭% ১,৬৭৪ জন
দিনাজপুর ৫৭.৪৯% ৬,২৬০ জন
চট্টগ্রাম ৫২.৫৭% ৬,০৯৭ জন
সিলেট ৫১.৮৬% ১,৬০২ জন
ময়মনসিংহ ৫১.৫৪% ২,৬৮৪ জন
যশোর ৫০.২০% ৫,৯৯৫ জন
কুমিল্লা ৪৮.৮৬% ২,৭০৭ জন

শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই ব্যাপক ফল বিপর্যয়ের পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন:

১. শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ঘাটতি: বোর্ড চেয়ারম্যান ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশ্নপত্র কিছুটা কঠিন হলেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব বা ঘাটতি ছিল, যার ফলে সামগ্রিক ফলাফল খারাপ হয়েছে।

২. গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুর্বলতা: তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা মূলত ইংরেজি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), এবং উচ্চতর গণিত— এই বিষয়গুলোতে খারাপ করেছে, যা পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।

৩. উত্তরপত্র মূল্যায়নে কঠোরতা (ওভার মার্কিং না করা): শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বোর্ড কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কোনো প্রকার ‘বাড়তি নম্বর’ বা ‘গ্রেস মার্ক’ দেওয়া হয়নি। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, সরকার, মন্ত্রণালয় বা বোর্ড থেকে পাসের হার বাড়ানোর জন্য বেশি নম্বর দেওয়ার কোনো নির্দেশনা ছিল না। তারা ‘ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততা’ বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

৪. কুমিল্লা বোর্ডে ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল: কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামসুল আলম এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রুনা নাসরীন জানিয়েছেন, এই বোর্ডে ১৬২টি ভেন্যু কেন্দ্র (যেখানে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয়) বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নিজ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দেওয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, নকলমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভিজিলেন্স টিমের উপস্থিতি এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে কঠোর মানদণ্ড বজায় রাখার নির্দেশও ফলকে প্রভাবিত করেছে।

শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এই ফলাফলকে ‘বাস্তবতা’ হিসেবে স্বীকার করে বলেন, “আমরা ‘অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি’ নয়, বরং ‘ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততা’কে বেছে নিয়েছি… আজ যদি আমরা সাহস করে বাস্তবতা স্বীকার না করি তাহলে মেধাবীদের প্রতি এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি আমরা অন্যায় করব।” তিনি ভবিষ্যতে এইচএসসি মূল্যায়নে সীমান্তরেখায় থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বোচ্চ ন্যায্যতা বজায় রাখতে বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে, অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু ফলাফলে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ২০ বছরের ইতিহাসে এটি খুবই খারাপ ফল। তিনি মনে করেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের অনিয়মিত ক্লাস, সরকারি কলেজে স্বেচ্ছাচারিতা এবং কোচিং-নির্ভরতা এই ফল বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, অতিরিক্ত নম্বর বা গ্রেস মার্ক না দেওয়া এবং অযোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রশাসনে পদায়নের কারণেই এমন ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে।

বোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যে সকল প্রতিষ্ঠান খারাপ করেছে তাদের চিহ্নিত করে কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ বোর্ড চেয়ারম্যানগণ খারাপ ফল করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে বসে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ঘাটতি দূর করতে মোটিভেশন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন।

জনপ্রিয়

‘জুলাই সনদে’ এনসিপি’র অনাস্থা: আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না হলে গণপ্রতারণা

উচ্চ মাধ্যমিকে ফল বিপর্যয়

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ২১ বছরের সর্বনিম্ন পাসের হার: পতন পাসে, তলানিতে জিপিএ-৫

প্রকাশিত : ১১:৫৫:১০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫

সাম্প্রতিক উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার রেকর্ড করা হয়েছে। এবারের ফলাফলে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ব্যাপকহারে কমে যাওয়ায় শিক্ষা মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর বকশি বাজারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন। প্রকাশিত ফলাফলের প্রধান দিকগুলো নিম্নরূপ:

পরীক্ষার ধরন পাসের হার জিপিএ-৫ প্রাপ্তি
এইচএসসি ও সমমান ৫৮.৮৩ শতাংশ ৬৯,০৯৭ জন
শুধুমাত্র এইচএসসি ৫৭.১২ শতাংশ ৬৩,২১৯ জন
আলিম (মাদরাসা) ৭৫.৬১ শতাংশ ৪,২৬৮ জন
কারিগরি ৬২.৬৭ শতাংশ ১,৬১০ জন

গত বছরের তুলনায় ফলাফল পতন:

সূচক পতনের পরিমাণ
পাসের হার হ্রাস ১৯.২৫ শতাংশ
জিপিএ-৫ প্রাপ্তি হ্রাস ৭৬,৮১৪ জন

বোর্ডভিত্তিক ফলাফলের তুলনামূলক চিত্র:

বোর্ড পাসের হার জিপিএ-৫ প্রাপ্তি
ঢাকা ৬৪.৬২% ২৬,০৬৩ জন
রাজশাহী ৫৯.৪০% ১০,১৩৭ জন
বরিশাল ৬২.৫৭% ১,৬৭৪ জন
দিনাজপুর ৫৭.৪৯% ৬,২৬০ জন
চট্টগ্রাম ৫২.৫৭% ৬,০৯৭ জন
সিলেট ৫১.৮৬% ১,৬০২ জন
ময়মনসিংহ ৫১.৫৪% ২,৬৮৪ জন
যশোর ৫০.২০% ৫,৯৯৫ জন
কুমিল্লা ৪৮.৮৬% ২,৭০৭ জন

শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই ব্যাপক ফল বিপর্যয়ের পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন:

১. শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ঘাটতি: বোর্ড চেয়ারম্যান ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশ্নপত্র কিছুটা কঠিন হলেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব বা ঘাটতি ছিল, যার ফলে সামগ্রিক ফলাফল খারাপ হয়েছে।

২. গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুর্বলতা: তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা মূলত ইংরেজি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), এবং উচ্চতর গণিত— এই বিষয়গুলোতে খারাপ করেছে, যা পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।

৩. উত্তরপত্র মূল্যায়নে কঠোরতা (ওভার মার্কিং না করা): শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বোর্ড কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কোনো প্রকার ‘বাড়তি নম্বর’ বা ‘গ্রেস মার্ক’ দেওয়া হয়নি। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, সরকার, মন্ত্রণালয় বা বোর্ড থেকে পাসের হার বাড়ানোর জন্য বেশি নম্বর দেওয়ার কোনো নির্দেশনা ছিল না। তারা ‘ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততা’ বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

৪. কুমিল্লা বোর্ডে ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল: কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামসুল আলম এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রুনা নাসরীন জানিয়েছেন, এই বোর্ডে ১৬২টি ভেন্যু কেন্দ্র (যেখানে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয়) বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নিজ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দেওয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, নকলমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভিজিলেন্স টিমের উপস্থিতি এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে কঠোর মানদণ্ড বজায় রাখার নির্দেশও ফলকে প্রভাবিত করেছে।

শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এই ফলাফলকে ‘বাস্তবতা’ হিসেবে স্বীকার করে বলেন, “আমরা ‘অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি’ নয়, বরং ‘ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততা’কে বেছে নিয়েছি… আজ যদি আমরা সাহস করে বাস্তবতা স্বীকার না করি তাহলে মেধাবীদের প্রতি এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি আমরা অন্যায় করব।” তিনি ভবিষ্যতে এইচএসসি মূল্যায়নে সীমান্তরেখায় থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বোচ্চ ন্যায্যতা বজায় রাখতে বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে, অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু ফলাফলে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ২০ বছরের ইতিহাসে এটি খুবই খারাপ ফল। তিনি মনে করেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের অনিয়মিত ক্লাস, সরকারি কলেজে স্বেচ্ছাচারিতা এবং কোচিং-নির্ভরতা এই ফল বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, অতিরিক্ত নম্বর বা গ্রেস মার্ক না দেওয়া এবং অযোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রশাসনে পদায়নের কারণেই এমন ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে।

বোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যে সকল প্রতিষ্ঠান খারাপ করেছে তাদের চিহ্নিত করে কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ বোর্ড চেয়ারম্যানগণ খারাপ ফল করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে বসে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ঘাটতি দূর করতে মোটিভেশন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন।