১০:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

গণভোট, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুই বিকল্প সুপারিশে যা আছে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দুটি বিকল্প সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়া গণভোটের সময় সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (অক্টোবর ২৮) দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ সুপারিশ জমা দেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি অবহিত আছেন যে, জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সূচনা হয়। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে তাকে বাস্তব রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কারের বিস্তারিত সুপারিশসহ পৃথক পৃথক প্রতিবেদন জমা দেয়। সংস্কারের সুপারিশের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের দায়িত্ব, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান এবং দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশসমূহ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা করবে এবং এই মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করবে।’

২.০। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ থেকে কাজ শুরু করে। কমিশন প্রথম পর্যায়ে পুলিশ সংস্কার কমিশন ব্যতীত অপর পাঁচটি সংস্কার কমিশনগুলির দেয়া সুপারিশসমূহের মধ্য হতে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ সম্পর্কে মতামত প্রদানের জন্য স্প্রেডশিট আকারে ৩৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নিকট প্রেরণ করে। এর মধ্যে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের নিকট প্রেরণ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে উল্লেখিত সুপারিশগুলো নিয়ে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সাথে পৃথক পৃথকভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৪৪টি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় পর্যায়ে মৌলিক সংস্কার বিবেচনায় ২০টি বিষয় নিয়ে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সাথে সম্মিলিতভাবে ২৩টি সভায় মিলিত হয় কমিশন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে সর্বমোট ৮৪টি সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে কোনো কোনো দল ও জোটের ভিন্নমত (Note of dissent) রয়েছে।

৪.০। জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় আলাপ-আলোচনার শেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এই মর্মে অনুরোধ জানানো হয়, কমিশন যাতে আলোচনায় গৃহীত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের উপায় এবং এগুলোকে আইনি ভিত্তি দেয়ার বিষয়ে সরকারকে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদান করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চতুর্থ পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের সাথে মোট ৫টি সভায় মিলিত হয়ে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি প্রদানের উপায় নিয়ে আলোচনা করে।

৫.০। পাশাপাশি কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি প্রদানের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত। গ্রহণের উদ্দেশ্যে ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি প্যানেল গঠন করে, যাতে সুপ্রিমকোর্টের দু’জন সাবেক বিচারপতি, তিনজন আইনজীবী এবং একজন আইনের অধ্যাপক ছিলেন। এই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাথে কমিশন মোট ১৩টি সভায় মিলিত হয় এবং জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। অপরদিকে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের সঙ্গে কমিশনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও অব্যাহত থাকে। এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করছে।

৬.০। ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে সরকার নিম্নোক্ত দু’টি বিকল্প পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন ও আইনগত ভিত্তি প্রদান করতে পারে:

৬.১। বিকল্প প্রস্তাব-১

(ক) জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫” শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। এরূপ প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-২-এ সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

(খ) জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে উক্ত আদেশ এবং তার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রণীত একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে।

(গ) উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একইসঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, যাহা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (Constituent Power) প্রয়োগ করতে পারবে।

(ঘ) উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায় তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করবে। তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

৬.২। বিকল্প প্রস্তাব-২

(ক) জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫” শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। এরূপ প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-৩-এ সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

(খ) জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং তার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবসমূহ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে।

(গ) উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, যাহা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (Constituent Power) প্রয়োগ করতে পারবে।

(ঘ) পরিষদ উহার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে উক্ত আদেশের তফসিল-১-এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে এবং তা সম্পন্ন করার পর পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হবে।

৭.০। উল্লেখিত উভয় বিকল্প প্রস্তাবের ক্ষেত্রে গণভোটে নিম্নরূপ প্রশ্ন উপস্থাপন করা হবে—

‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং উহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’

৮.০। উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা উক্ত নির্বাচনের দিন উক্ত আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।

৯.০। উক্ত আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবি, সংবিধান সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপনের পদ্ধতি, উক্ত প্রস্তাবের বিবেচনা ও গ্রহণসহ সকল বিষয়ে কার্যপ্রণালি নির্ধারণ করবে।

১০.০। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত হবে।

১১.০। সার্বভৌম জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তির ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে বিধায় তৎকর্তৃক গৃহীত সংবিধান সংস্কার চূড়ান্ত হবে এবং উক্তরূপ সংস্কার বিষয়ে অন্য কোনোভাবে অনুমোদন বা সম্মতির প্রয়োজন হবে না।

১২.০। উক্ত আদেশের বিধানাবলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করতে পারবে।

১৩.০। ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ উল্লেখিত যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আইন, বিধি-বিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করা দরকার সরকার তা অধ্যাদেশ জারি ও বিধি-বিধান প্রণয়ন/সংশোধন (সংযুক্তি-৪) করে বাস্তবায়ন করতে পারে।

১৪.০। ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর যে সকল সিদ্ধান্ত নির্বাহী আদেশে (সংযুক্তি-৫) বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো অবিলম্বে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

স্বাধীনতার সুফল আমরা ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি : মামুনুল হক

গণভোট, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুই বিকল্প সুপারিশে যা আছে

প্রকাশিত : ০৭:৪৮:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দুটি বিকল্প সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়া গণভোটের সময় সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (অক্টোবর ২৮) দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ সুপারিশ জমা দেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি অবহিত আছেন যে, জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সূচনা হয়। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে তাকে বাস্তব রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কারের বিস্তারিত সুপারিশসহ পৃথক পৃথক প্রতিবেদন জমা দেয়। সংস্কারের সুপারিশের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের দায়িত্ব, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান এবং দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশসমূহ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা করবে এবং এই মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করবে।’

২.০। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ থেকে কাজ শুরু করে। কমিশন প্রথম পর্যায়ে পুলিশ সংস্কার কমিশন ব্যতীত অপর পাঁচটি সংস্কার কমিশনগুলির দেয়া সুপারিশসমূহের মধ্য হতে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ সম্পর্কে মতামত প্রদানের জন্য স্প্রেডশিট আকারে ৩৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নিকট প্রেরণ করে। এর মধ্যে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের নিকট প্রেরণ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে উল্লেখিত সুপারিশগুলো নিয়ে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সাথে পৃথক পৃথকভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৪৪টি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় পর্যায়ে মৌলিক সংস্কার বিবেচনায় ২০টি বিষয় নিয়ে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সাথে সম্মিলিতভাবে ২৩টি সভায় মিলিত হয় কমিশন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে সর্বমোট ৮৪টি সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে কোনো কোনো দল ও জোটের ভিন্নমত (Note of dissent) রয়েছে।

৪.০। জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় আলাপ-আলোচনার শেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এই মর্মে অনুরোধ জানানো হয়, কমিশন যাতে আলোচনায় গৃহীত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের উপায় এবং এগুলোকে আইনি ভিত্তি দেয়ার বিষয়ে সরকারকে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদান করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চতুর্থ পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের সাথে মোট ৫টি সভায় মিলিত হয়ে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি প্রদানের উপায় নিয়ে আলোচনা করে।

৫.০। পাশাপাশি কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি প্রদানের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত। গ্রহণের উদ্দেশ্যে ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি প্যানেল গঠন করে, যাতে সুপ্রিমকোর্টের দু’জন সাবেক বিচারপতি, তিনজন আইনজীবী এবং একজন আইনের অধ্যাপক ছিলেন। এই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাথে কমিশন মোট ১৩টি সভায় মিলিত হয় এবং জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। অপরদিকে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের সঙ্গে কমিশনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও অব্যাহত থাকে। এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করছে।

৬.০। ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে সরকার নিম্নোক্ত দু’টি বিকল্প পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন ও আইনগত ভিত্তি প্রদান করতে পারে:

৬.১। বিকল্প প্রস্তাব-১

(ক) জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫” শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। এরূপ প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-২-এ সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

(খ) জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে উক্ত আদেশ এবং তার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রণীত একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে।

(গ) উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একইসঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, যাহা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (Constituent Power) প্রয়োগ করতে পারবে।

(ঘ) উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায় তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করবে। তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

৬.২। বিকল্প প্রস্তাব-২

(ক) জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫” শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। এরূপ প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-৩-এ সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

(খ) জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং তার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবসমূহ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে।

(গ) উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, যাহা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (Constituent Power) প্রয়োগ করতে পারবে।

(ঘ) পরিষদ উহার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে উক্ত আদেশের তফসিল-১-এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে এবং তা সম্পন্ন করার পর পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হবে।

৭.০। উল্লেখিত উভয় বিকল্প প্রস্তাবের ক্ষেত্রে গণভোটে নিম্নরূপ প্রশ্ন উপস্থাপন করা হবে—

‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং উহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’

৮.০। উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা উক্ত নির্বাচনের দিন উক্ত আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।

৯.০। উক্ত আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবি, সংবিধান সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপনের পদ্ধতি, উক্ত প্রস্তাবের বিবেচনা ও গ্রহণসহ সকল বিষয়ে কার্যপ্রণালি নির্ধারণ করবে।

১০.০। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত হবে।

১১.০। সার্বভৌম জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তির ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে বিধায় তৎকর্তৃক গৃহীত সংবিধান সংস্কার চূড়ান্ত হবে এবং উক্তরূপ সংস্কার বিষয়ে অন্য কোনোভাবে অনুমোদন বা সম্মতির প্রয়োজন হবে না।

১২.০। উক্ত আদেশের বিধানাবলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করতে পারবে।

১৩.০। ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ উল্লেখিত যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আইন, বিধি-বিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করা দরকার সরকার তা অধ্যাদেশ জারি ও বিধি-বিধান প্রণয়ন/সংশোধন (সংযুক্তি-৪) করে বাস্তবায়ন করতে পারে।

১৪.০। ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর যে সকল সিদ্ধান্ত নির্বাহী আদেশে (সংযুক্তি-৫) বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো অবিলম্বে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।