সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে সরকার দুটি সমধর্মী প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে থাকা পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট (আইপিআইএম) এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রস্তাবিত সেন্টার অব এক্সিলেন্স (সিওই) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে একটি একক ও যৌথ প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ইকবাল আবদুল্লাহ হারুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সভায় ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, উভয় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তাবৃন্দ, পরিকল্পনা কমিশন এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) সহ অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররা অংশ নেন। উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা স্বীকার করেন যে, সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা, কার্যকারিতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষমতা বৃদ্ধি করাই তাদের প্রধান ও অভিন্ন লক্ষ্য।

একীভূতকরণের যৌক্তিকতা ও প্রেক্ষাপট

সভায় আইপিআইএম এবং সিওইর একীভূতকরণের প্রধান যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়:

• অভিন্ন লক্ষ্য: পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন উল্লেখ করেন যে, আইপিআইএম এবং ইআরডি’র সিওইর লক্ষ্য একই (সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি) হওয়ায় একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদের একীভূত করা যৌক্তিক ও কার্যকর।

• ইআরডি’র অবস্থান: ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী জানান, তাদের প্রস্তাবিত সিওইর লক্ষ্য হলো ইআরডিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা এবং প্রশিক্ষক দল তৈরি করা। যেহেতু আইপিআইএম এবং সিওইর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই, তাই তিনি কার্যক্রম একীভূত করে যৌথভাবে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় আপত্তি থাকবে না বলে উল্লেখ করেন।

• এডিবির সহায়তা: এডিবির লিড সিনিয়র সেক্টর অফিসার এস এম ইবাদুর রহমান বলেন, সিওই মূলত এডিবির কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এতে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। এই সুযোগটি পরিকল্পনা বিভাগের প্রস্তাবনার পথ খুলে দিয়েছে, যেখানে পরিকল্পনা কমিশনের কম্পাউন্ডে একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।

• দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুনরাবৃত্তি হ্রাস: সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মত দেন যে, দুটি প্রতিষ্ঠান একীভূত হলে সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় বাড়বে এবং কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি কমবে।

আইপিআইএম এর বর্তমান অবস্থা ও সহায়তা

পরিকল্পনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নুরুন নাহার জানান, সরকারের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষ কর্মকর্তা তৈরি এবং প্রশিক্ষণ ও গবেষণার লক্ষ্যে আইপিআইএম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের কর্মকর্তাদের বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ‘Improvement of Public Investment Management System (IPiMS)’ প্রকল্প থেকে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।

তাছাড়া, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে নেওয়া ‘Strengthening Institutions for Transparency and Accountability (SITA)’ শীর্ষক কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায়ও আইপিআইএমকে সহায়তা দেওয়া হবে। বর্তমানে আইপিআইএম এনইসি ভবনের অস্থায়ী অফিস থেকে সীমিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে।

মূল সুপারিশসমূহ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সভায় নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও সুপারিশসমূহ নেওয়া হয়:

• একক প্রতিষ্ঠান গঠন: পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট (আইপিআইএম) এবং সেন্টার অব এক্সিলেন্স (সিওই) একীভূত করে একটি একক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে, যা পরিকল্পনা বিভাগ ও ইআরডি যৌথভাবে পরিচালনা করবে।

• অবকাঠামো: পরিকল্পনা কমিশনের কম্পাউন্ডে দুই তলা ও দুই বেসমেন্ট বিশিষ্ট আধুনিক একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে, যেখানে প্রশিক্ষণ কক্ষ এবং পার্কিং সুবিধা থাকবে।

• ব্যবহারকারী: এই প্রতিষ্ঠানটি পরিকল্পনা বিভাগ, ইআরডি, পরিকল্পনা কমিশন এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবে।

• পরিচালনা কাঠামো: গভর্নিং বোর্ডে উভয় বিভাগের প্রতিনিধিরা থাকবেন এবং ইআরডি সচিব কো-চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

• বাস্তবায়ন: চূড়ান্ত বাস্তবায়ন, সম্ভাব্যতা যাচাই এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার পরামর্শের পর শুরু হবে।

জাতীয় গুরুত্ব

বাংলাদেশে পাবলিক বিনিয়োগের কার্যকারিতা দীর্ঘদিন ধরেই বাস্তবায়ন বিলম্ব, সমন্বয় জটিলতা এবং দক্ষতার ঘাটতির কারণে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দুটি সমধর্মী প্রতিষ্ঠান একীভূত করার এই উদ্যোগটি সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব, প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কাঠামোর সামঞ্জস্য বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিকল্পনা বিভাগের এক কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, এই উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এটি বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বমানের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা একাডেমি হিসেবে কাজ করবে, যা সরকারি পরিকল্পনা, আর্থিক শাসন এবং উন্নয়ন কার্যকারিতা একীভূত করবে। এটি ভবিষ্যতের নীতি-নির্ধারণ, তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা এবং টেকসই বিনিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।