দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সম্প্রতি এক ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য চরম হতাশা ও লজ্জার কারণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) কর্তৃক পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে ১ হাজার ১৮৬ জন জাল সনদধারী শিক্ষককে শনাক্ত করা হয়েছে। যে শিক্ষকরা ‘জাতির কারিগর’ হিসেবে খ্যাতি ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, তাদের পেশাজীবন যদি অসদুপায় ও জালিয়াতির মাধ্যমে শুরু হয়, তা কেবল নৈতিক অবক্ষয়ই নয়, বরং সমগ্র নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিপ্রবণতা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার সাক্ষ্য বহন করে।
📉 ভয়াবহ পরিসংখ্যান ও আর্থিক অনিয়ম
‘কালযাত্রা’য় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, এই অভিযানে শনাক্ত হওয়া জাল সনদধারী শিক্ষকদের মধ্যে চার শতাধিক শিক্ষকের সনদ ‘জাল ও ভুয়া’ এবং তিন শতাধিক শিক্ষকের সনদ ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই শিক্ষকরা বেতন-ভাতা হিসেবে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেছেন। ডিআইএ তাদের কাছ থেকে মোট ২৫৩ কোটি টাকা আদায় করার জন্য সুপারিশ করেছে। এই বিশাল অঙ্কের আর্থিক অনিয়ম প্রমাণ করে, জালিয়াতির এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল।
👻 ভূত তাড়ানো প্রতিষ্ঠান নিজেই ভূত
এই ঘটনার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, যেই প্রতিষ্ঠানটির মূল কাজই ছিল জাল সনদসহ অন্যান্য নিরীক্ষামূলক কাজ সম্পাদন করা— সেই পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, বিগত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটি এ ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যকর অভিযান পরিচালনা করেনি। বরং অভিযোগ উঠেছে, অনেক ক্ষেত্রে জাল সনদ ধরা পড়লেও ঘুষের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। খোদ পরিদর্শকদের একটি চক্রই শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ভুয়া সনদধারীদের ছাড় দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ করত। জাল সনদের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার আটকে থাকা ফাইল নতুন করে যাচাই করতে গিয়েই বেরিয়ে এসেছে এই ভয়াবহ চিত্র।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও জাল সনদ জানার পরও অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিষয়টি চেপে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ, যে বা যারা দুর্নীতি নামের ‘ভূত’ তাড়াবে, তারা নিজেরাই স্বয়ং ‘ভূত’ হয়ে শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে গেড়ে বসেছেন।
❓ নীতি-নৈতিকতা ও জবাবদিহির প্রশ্ন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে এই দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা কেবল শিক্ষকদের ব্যক্তিগত নৈতিক অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত নয়; এটি প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও জবাবদিহির অভাবকেই সামনে আনে। শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ইস্যুতে এমন ছেলেখেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো: একজন শিক্ষক যদি জাল সনদে চাকরি নেন, তিনি শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দিতে পারেন? শিক্ষক মানেই নীতিনৈতিকতা ও আদর্শের প্রতীক, যার জ্ঞান ও আদর্শের আলোয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আলোকিত হবে। সেই শিক্ষকই যদি নীতিভ্রষ্ট হন, তবে তা পুরো জাতির সঙ্গেই চরম ধোঁকাবাজি।এই ধোঁকাবাজ শিক্ষকরা শিক্ষকতা নামের এই পবিত্র পেশাকেই কলঙ্কিত করেছেন। তবে এর চেয়েও বড় অন্যায় করেছেন সেই অসাধু কর্মকর্তারা, যাদের অসততার কারণেই নীতিহীন, মানহীন ও অদক্ষ ব্যক্তিরা শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে, যা সার্বিকভাবে শিক্ষার গুণগত মানের জন্য অমঙ্গলজনক।
🚀 প্রত্যাশিত পদক্ষেপ
আমরা মনে করি, এই গুরুতর বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক:
১. আইনের আওতায় আনা: দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা অপরিহার্য। ২. ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: শনাক্ত হওয়া ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করা ২৫৩ কোটি টাকা দ্রুত আদায় নিশ্চিত করতে হবে। ৩. কার্যকর সংস্কার: সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে (ডিআইএ, মাউশি) এসব অনিয়ম-দুর্নীতি হ্রাসে কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনাগত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে কেউ এই ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় না নিতে পারে, তার জন্য কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক 






















