০৯:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫

ত্রিমুখী লড়াইয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি: আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নতুন মেরুকরণ

দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত আওয়ামী লীগ (ক্ষমতাসীন) এবং বিএনপি (প্রধান বিরোধী দল)-এর দ্বিমুখী মেরুকরণে আবর্তিত হচ্ছিল। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি দৃশ্যপটকে নাটকীয়ভাবে পাল্টে দিয়েছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ফলে এখন রাজনীতির ময়দানে বিএনপিকে নতুন ও জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যেখানে পুরনো প্রতিপক্ষের পাশাপাশি একসময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামী একটি শক্তিশালী ফ্রন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ত্রিমুখী লড়াইয়ের সূচনা করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

১. আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া প্রেতাত্মা ও সাইবার প্রোপাগান্ডা

গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার তীব্র বৈরিতা দেখে এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও, বিএনপিকে এখনও তাদের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক ও সাইবার প্রেতাত্মার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতেও তাদের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা, বিশেষ করে যারা বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়, তারা সক্রিয় রয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা প্রতিনিয়ত মিথ্যা তথ্য ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে জনমনে সংশয় তৈরির চেষ্টা করছে। সাইবার স্পেসে এই আক্রমণকে বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

২. বিএনপি-জামায়াত: পুরনো মিত্রতায় চরম তিক্ততা

একসময় যারা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জোট বেঁধেছিল, সেই বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেকার সম্পর্ক এখন চরম তিক্ততায় রূপ নিয়েছে। এই দ্বন্দ্ব আর তৃণমূল পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, তা পৌঁছে গেছে উভয় দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

শীর্ষ নেতাদের প্রকাশ্য বাকযুদ্ধ

এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ হলো আগামী নির্বাচনে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। বিএনপি এককভাবে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাইছে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী তাদের পুরোনো মিত্রতার ট্যাগ ঝেড়ে ফেলে নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর।

  • তারেক রহমানের কঠোর সমালোচনা: গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ কর্মসূচিতে জামায়াতে ইসলামীর নাম উল্লেখ না করেই তাদের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা ও মা-বোনদের ওপর নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। একইসঙ্গে, তিনি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়েও কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে জামায়াতের রাজনীতিকে ইঙ্গিত করে ‘বেহেশত-দোজখের টিকিট বিক্রির’ মতো কাজকে ‘শিরক’ বলে অভিহিত করেন।

  • ডা. শফিকুর রহমানের পাল্টা জবাব: পরদিন ৮ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান তারেক রহমানের বক্তব্যের জবাবে বলেন, জামায়াত ধর্মকে ব্যবহার করে না, বরং ধারণ করে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় যারা নতুন করে নামাজ শুরু করেন বা তসবিহ হাতে ঘোরেন, তারাই সম্ভবত ধর্মকে ব্যবহার করেন।

এই সরাসরি বাক্যবিনিময় নিশ্চিত করে যে, নির্বাচনের মাঠে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদও এই বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, তারা ইতিহাসের সত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই কথা বলছেন।

তৃণমূল পর্যায়ে সংঘাত

কেন্দ্রীয় নেতাদের এই তপ্ত বাক্যবিনিময় তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়েছে।

  • সিলেটে এক সমাবেশে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বিএনপিকে ইঙ্গিত করে ‘চাঁদাবাজি’, ‘দখলদারিত্ব’ এবং ‘ফ্যাসিবাদী’ আচরণের গুরুতর অভিযোগ আনেন। এর মাধ্যমে জামায়াত বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মতোই আরেকটি শক্তি হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে।

  • অন্যদিকে, ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামায়াতের ধর্মীয় রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “জামায়াতের টিকিট কাটলেই কি কেউ বেহেশতে যেতে পারবে?”

  • এর জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার অভিযোগ করেন, “বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলছে,” এবং তারা জামায়াতকে বাধা দিয়ে মূলত ইসলামকেই বাধাগ্রস্ত করছে।

এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগে দুই দলই তাদের নিজ নিজ ভোট ব্যাংক সংহত করার পাশাপাশি একে অপরের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

৩. জামায়াত-আওয়ামী লীগের অলিখিত সমঝোতার গুঞ্জন

রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে কৌতূহল জাগানিয়া বিষয় হলো বিএনপিকে কোণঠাসা করতে জামায়াতে ইসলামীর সাথে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এক ধরনের অলিখিত সমঝোতার গুঞ্জন।

 যেহেতু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না, তাই তাদের বিশাল ভোট ব্যাংক কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। জামায়াত কৌশলে আওয়ামী লীগের এই বিশাল ভোট ব্যাংকের দিকে নজর দিয়েছে। গত বছর (২০২৪ সালের) ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ওপর যে নির্যাতন করেছে, দল হিসেবে তারা তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এটিকে জামায়াতের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জেও জামায়াত তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছে এবং মামলা প্রত্যাহারে তৎপরতা দেখাচ্ছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার স্পষ্ট করেছেন যে, যেহেতু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নেই, তাদের সাধারণ ভোটাররা এখন দলীয় আদর্শের চেয়ে নিরাপত্তা, সৎ চরিত্র এবং দুর্নীতির অনুপস্থিতি দেখে ভোট দেবেন, আর জামায়াত এই সুযোগ নিতে প্রস্তুত।সম্প্রতি এক নির্বাচনী প্রচারণায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আওয়ামী লীগের সাবেক রেলমন্ত্রীকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে আওয়ামী লীগের ভোটারদের কাছে ভোট চেয়েছেন, যা বিএনপি কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।এই কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট টানতে জামায়াত সখ্যতার পথ ধরে কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে।

৪. বিএনপির কঠিন চ্যালেঞ্জ: নির্বাচন ও নেতৃত্ব সংকট

বিএনপি বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে। একদিকে নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব সংকট বিরাজমান। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত ২৩ নভেম্বর থেকে সিসিইউতে আছেন এবং তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনও নির্বাসিত। যদিও তফসিল ঘোষণার পরপরই তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশে ফিরেই তাকে একদিকে দলকে সুসংগঠিত করতে হবে, অন্যদিকে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। জামায়াতের সুসংগঠিত অনলাইন ইউনিট এবং আওয়ামী লীগের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের যৌথ সাইবার আক্রমণ মোকাবেলা করা এখন বিএনপির জন্য অত্যাবশ্যক।এই জটিল ত্রিমুখী লড়াইয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘদিনের পরিচিত সমীকরণগুলো ভেঙে যাওয়ায় আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করতে যাচ্ছে।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

স্বাধীনতার সুফল আমরা ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি : মামুনুল হক

ত্রিমুখী লড়াইয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি: আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নতুন মেরুকরণ

প্রকাশিত : ০৮:৩৩:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত আওয়ামী লীগ (ক্ষমতাসীন) এবং বিএনপি (প্রধান বিরোধী দল)-এর দ্বিমুখী মেরুকরণে আবর্তিত হচ্ছিল। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি দৃশ্যপটকে নাটকীয়ভাবে পাল্টে দিয়েছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ফলে এখন রাজনীতির ময়দানে বিএনপিকে নতুন ও জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যেখানে পুরনো প্রতিপক্ষের পাশাপাশি একসময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামী একটি শক্তিশালী ফ্রন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ত্রিমুখী লড়াইয়ের সূচনা করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

১. আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া প্রেতাত্মা ও সাইবার প্রোপাগান্ডা

গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার তীব্র বৈরিতা দেখে এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও, বিএনপিকে এখনও তাদের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক ও সাইবার প্রেতাত্মার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতেও তাদের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা, বিশেষ করে যারা বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়, তারা সক্রিয় রয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা প্রতিনিয়ত মিথ্যা তথ্য ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে জনমনে সংশয় তৈরির চেষ্টা করছে। সাইবার স্পেসে এই আক্রমণকে বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

২. বিএনপি-জামায়াত: পুরনো মিত্রতায় চরম তিক্ততা

একসময় যারা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জোট বেঁধেছিল, সেই বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেকার সম্পর্ক এখন চরম তিক্ততায় রূপ নিয়েছে। এই দ্বন্দ্ব আর তৃণমূল পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, তা পৌঁছে গেছে উভয় দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

শীর্ষ নেতাদের প্রকাশ্য বাকযুদ্ধ

এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ হলো আগামী নির্বাচনে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। বিএনপি এককভাবে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাইছে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী তাদের পুরোনো মিত্রতার ট্যাগ ঝেড়ে ফেলে নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর।

  • তারেক রহমানের কঠোর সমালোচনা: গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ কর্মসূচিতে জামায়াতে ইসলামীর নাম উল্লেখ না করেই তাদের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা ও মা-বোনদের ওপর নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। একইসঙ্গে, তিনি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়েও কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে জামায়াতের রাজনীতিকে ইঙ্গিত করে ‘বেহেশত-দোজখের টিকিট বিক্রির’ মতো কাজকে ‘শিরক’ বলে অভিহিত করেন।

  • ডা. শফিকুর রহমানের পাল্টা জবাব: পরদিন ৮ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান তারেক রহমানের বক্তব্যের জবাবে বলেন, জামায়াত ধর্মকে ব্যবহার করে না, বরং ধারণ করে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় যারা নতুন করে নামাজ শুরু করেন বা তসবিহ হাতে ঘোরেন, তারাই সম্ভবত ধর্মকে ব্যবহার করেন।

এই সরাসরি বাক্যবিনিময় নিশ্চিত করে যে, নির্বাচনের মাঠে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদও এই বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, তারা ইতিহাসের সত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই কথা বলছেন।

তৃণমূল পর্যায়ে সংঘাত

কেন্দ্রীয় নেতাদের এই তপ্ত বাক্যবিনিময় তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়েছে।

  • সিলেটে এক সমাবেশে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বিএনপিকে ইঙ্গিত করে ‘চাঁদাবাজি’, ‘দখলদারিত্ব’ এবং ‘ফ্যাসিবাদী’ আচরণের গুরুতর অভিযোগ আনেন। এর মাধ্যমে জামায়াত বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মতোই আরেকটি শক্তি হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে।

  • অন্যদিকে, ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামায়াতের ধর্মীয় রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “জামায়াতের টিকিট কাটলেই কি কেউ বেহেশতে যেতে পারবে?”

  • এর জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার অভিযোগ করেন, “বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলছে,” এবং তারা জামায়াতকে বাধা দিয়ে মূলত ইসলামকেই বাধাগ্রস্ত করছে।

এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগে দুই দলই তাদের নিজ নিজ ভোট ব্যাংক সংহত করার পাশাপাশি একে অপরের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

৩. জামায়াত-আওয়ামী লীগের অলিখিত সমঝোতার গুঞ্জন

রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে কৌতূহল জাগানিয়া বিষয় হলো বিএনপিকে কোণঠাসা করতে জামায়াতে ইসলামীর সাথে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এক ধরনের অলিখিত সমঝোতার গুঞ্জন।

 যেহেতু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না, তাই তাদের বিশাল ভোট ব্যাংক কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। জামায়াত কৌশলে আওয়ামী লীগের এই বিশাল ভোট ব্যাংকের দিকে নজর দিয়েছে। গত বছর (২০২৪ সালের) ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ওপর যে নির্যাতন করেছে, দল হিসেবে তারা তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এটিকে জামায়াতের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জেও জামায়াত তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছে এবং মামলা প্রত্যাহারে তৎপরতা দেখাচ্ছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার স্পষ্ট করেছেন যে, যেহেতু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নেই, তাদের সাধারণ ভোটাররা এখন দলীয় আদর্শের চেয়ে নিরাপত্তা, সৎ চরিত্র এবং দুর্নীতির অনুপস্থিতি দেখে ভোট দেবেন, আর জামায়াত এই সুযোগ নিতে প্রস্তুত।সম্প্রতি এক নির্বাচনী প্রচারণায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আওয়ামী লীগের সাবেক রেলমন্ত্রীকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে আওয়ামী লীগের ভোটারদের কাছে ভোট চেয়েছেন, যা বিএনপি কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।এই কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট টানতে জামায়াত সখ্যতার পথ ধরে কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে।

৪. বিএনপির কঠিন চ্যালেঞ্জ: নির্বাচন ও নেতৃত্ব সংকট

বিএনপি বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে। একদিকে নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব সংকট বিরাজমান। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত ২৩ নভেম্বর থেকে সিসিইউতে আছেন এবং তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনও নির্বাসিত। যদিও তফসিল ঘোষণার পরপরই তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশে ফিরেই তাকে একদিকে দলকে সুসংগঠিত করতে হবে, অন্যদিকে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। জামায়াতের সুসংগঠিত অনলাইন ইউনিট এবং আওয়ামী লীগের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের যৌথ সাইবার আক্রমণ মোকাবেলা করা এখন বিএনপির জন্য অত্যাবশ্যক।এই জটিল ত্রিমুখী লড়াইয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘদিনের পরিচিত সমীকরণগুলো ভেঙে যাওয়ায় আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করতে যাচ্ছে।