০৯:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
গুম, নির্যাতন ও আন্দোলনের বিবরণ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর জবানবন্দি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মো. আবুল হাসনাত (হাসনাত আবদুল্লাহ নামে পরিচিত) সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ জবানবন্দি প্রদানের সময় ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন তাকে তুলে নেওয়া, আটক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং আন্দোলনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১. আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায় (জুলাই ২০২৪)

হাসনাত তার বর্ণনা ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করেন। ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই, ছয়জন হত্যার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারাদেশে গায়েবানা জানাজা পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।

  • টিয়ার গ্যাস ও গ্রেপ্তার: সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। সমন্বয়করা অমর একুশে হল থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে যেতে চাইলে পুলিশ ও বিজিবি তাদের ওপর টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এই আক্রমণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। সেদিনই ডাকসু নির্বাচিত সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

  • গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল: গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময়ও বিজিবি ও পুলিশ পুনরায় আক্রমণ চালায়, এতে হাসনাতসহ অসংখ্য ছাত্র আহত হন। এ সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সদস্যরা গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।

২. অপহরণ, পদ্মায় চাপ এবং সেইফ হাউসে আটক (১৭-১৮ জুলাই)

১৭ জুলাই রাতে হল বন্ধ থাকায় হাসনাত তার মামার বাসা (সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায়) এবং তার সঙ্গে আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম অবস্থান করছিলেন।

  • তুলে নেওয়া ও হুমকি: সেদিন রাতে ডিজিএফআই সদস্যরা পরিবারসহ ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে তাদের দুজনকে তুলে নিয়ে যায়।

  • রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা: তাদের প্রথমে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তৎকালীন তিনজন মন্ত্রী—আনিসুল হক, মোহাম্মদ এ আরাফাত ও মহিবুল হাসান নওফেল প্রবেশ করেন। ডিজিএফআই সদস্যরা টানা এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নানা প্রলোভন, ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করে তাদের মন্ত্রীদের সাথে শুধু ‘মিটিং’ করতে চাপ দেন।

  • মিটিংয়ে অস্বীকৃতি: হাসনাতসহ অন্য সমন্বয়ক নাহিদ ও আসিফের সাথে কথা না বলে তারা মিটিং করতে অস্বীকৃতি জানালে ডিজিএফআই ক্ষুব্ধ হয় এবং ওই তিনজন মন্ত্রী চলে যান।

  • সেইফ হাউসে জিজ্ঞাসাবাদ: মিটিং করতে ব্যর্থ হওয়ার পর ডিজিএফআই তাদের বাসায় ফেরত না দিয়ে মৎস্য ভবন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মাঝে একটি গোপন ‘সেইফ হাউজে’ নিয়ে আটক রাখে। সেখানে ডিজিএফআই সহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করে।

    • জিজ্ঞাসাবাদকারী ব্যক্তি সেইফ হাউজের পেছনে থাকা টিভি সেটে ডিবিসি, সময় টিভি ও একাত্তর টিভিতে ফোন করে সংবাদ পরিবর্তন ও স্ক্রল সংশোধনের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। টিভি চ্যানেলগুলো সেই অনুযায়ী সংবাদ প্রচার করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছিল।

    • জিজ্ঞাসাবাদকালে একজন সেনা কর্মকর্তা হাসনাতকে বলেন যে, তিনি ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ১০ মিনিটে বিএনপির আন্দোলন নস্যাৎ করেছিলেন এবং তাদের আন্দোলন নস্যাৎ করতেও তার সময় লাগবে না।

৩. সহ-সমন্বয়ক হাসিবের গ্রেপ্তার ও মিথ্যা প্রচার

জিজ্ঞাসাবাদকারীরা হাসনাতের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অন্য সমন্বয়কদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছিল।

  • হাসিবের গ্রেপ্তার: হাসনাতের ফোন দিয়ে একপর্যায়ে সমন্বয়ক হাসিবের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। হাসিব চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনে আছেন জানতে পারার পর ডিজিএফআই তাকেও তুলে এনে আটক রাখে।

  • শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন: হাসনাত, সারজিস ও হাসিবকে সেখানে নানাভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। হাসিব মাদরাসার ছাত্র হওয়ায় তাকে ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।

  • সংবাদ মাধ্যমে মিথ্যাচার: দেশবাসীর কাছে আন্দোলনকারীদের ‘ভিলেন’ বানানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে মিথ্যা খবর প্রচার করা হয় যে তারা সরকারের সাথে আলোচনায় বসেছেন।

  • খণ্ডিত প্রচার: যখনই তাদের মিডিয়ার সামনে আনা হতো, তারা শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিতেন। কিন্তু সময়, একাত্তর ও ডিবিসি এই বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়ায়।

৪. প্রেস কনফারেন্সের নাটকীয়তা ও ক্যান্টনমেন্টে আটক

১৮ জুলাই সন্ধ্যায় ডিজিএফআইয়ের ডিজিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সেইফ হাউজে উপস্থিত হয়ে সর্বশেষবারের মতো আন্দোলন প্রত্যাহার করতে চাপ প্রয়োগ করেন।

  • শর্তসাপেক্ষে পদ্মা: বাইরে কারও সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় হাসনাত, সারজিস ও হাসিব সিদ্ধান্ত নেন যে তাদের প্রেস কনফারেন্স করে দাবি-দাওয়া জানাতে দিলে তারা পদ্মায় যাবেন।

  • দাবি লিখিত প্রকাশ: পদ্মায় গিয়ে তারা প্রেস কনফারেন্স করে তাদের দাবি-দাওয়া লিখিতভাবে প্রকাশ করেন। তারা বারবার বলেন, তারা সরকারের সঙ্গে কোনো মিটিংয়ে আসেননি এবং তাদের শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

  • বিকৃত সংবাদ প্রচার: দুঃখজনকভাবে মিডিয়া তাদের বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে। শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করার জন্য এক সেনা কর্মকর্তা মিডিয়ার সামনেই চাপ দিলেও তারা অস্বীকৃতি জানালে সেদিন রাতে তাদের ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন, তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বিকৃতভাবে প্রচার করে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে মর্মে খবর পরিবেশিত হচ্ছে।

৫. গুম, কারফিউ ও ডিবি নির্যাতন (১৯ জুলাই – ১ আগস্ট)

  • নাহিদ গুম ও নয় দফা: ১৯ জুলাই ছাড়া পেয়ে তারা জানতে পারেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে গুম করা হয়েছে। পরে তারা নাহিদকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে খুঁজে পান। একই সময়ে আরেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ‘নয় দফা’ ঘোষণা করেন।

  • কারফিউ ও আসিফ-বাকের গুম: ১৯ জুলাই রাতে সরকার পরের দিন থেকে কারফিউ ঘোষণা করে। এরপর সমন্বয়ক আসিফ ও বাকের গুম হন। তাদের বাবা-মাকে সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। নাহিদ চাপ উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরের দিন আসিফ ও বাকেরকেও গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

  • ডিবি অফিসে অমানুষিক নির্যাতন: ২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে আসিফ, বাকের ও নাহিদকে তুলে নিয়ে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। পরদিন ২৭ জুলাই হাসনাত ও সারজিসকে এবং ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি অফিসে তুলে নেওয়া হয়।

    • হাসনাত এডিসি জুনায়েদের অধীনে ছিলেন এবং তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তাকে একবার সারারাত বাথরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন প্রত্যাহার করা।

    • এই কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করেছিলেন ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশীদ, যিনি কয়েকবার তাদের রুমে ডেকে হুমকি দেন।

    • সমন্বয়করা হাঙ্গার স্ট্রাইক করার চেষ্টা করলে ডিবি হারুন খাওয়ার ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে দেন।

  • মুক্তি: ডিবি হারুন একপর্যায়ে ছয় সমন্বয়ককে তার রুমে ডেকে এনে একটি লিখিত বর্ণনা নাহিদকে দিয়ে পাঠ করান। সেই ভিডিও প্রচার করে বলা হয় নাহিদ আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে। ১ আগস্ট দুপুর দুইটার দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার সময় তারা প্রায় ৩০ ঘণ্টাব্যাপী অনশন অবস্থায় ছিলেন। বের হয়ে এসেই তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

হাসনাত তার জবানবন্দির শেষে জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেন।

জনপ্রিয়

স্বাধীনতার সুফল আমরা ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি : মামুনুল হক

গুম, নির্যাতন ও আন্দোলনের বিবরণ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর জবানবন্দি

প্রকাশিত : ০৮:৪৭:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মো. আবুল হাসনাত (হাসনাত আবদুল্লাহ নামে পরিচিত) সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ জবানবন্দি প্রদানের সময় ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন তাকে তুলে নেওয়া, আটক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং আন্দোলনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১. আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায় (জুলাই ২০২৪)

হাসনাত তার বর্ণনা ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করেন। ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই, ছয়জন হত্যার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারাদেশে গায়েবানা জানাজা পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।

  • টিয়ার গ্যাস ও গ্রেপ্তার: সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। সমন্বয়করা অমর একুশে হল থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে যেতে চাইলে পুলিশ ও বিজিবি তাদের ওপর টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এই আক্রমণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। সেদিনই ডাকসু নির্বাচিত সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

  • গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল: গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময়ও বিজিবি ও পুলিশ পুনরায় আক্রমণ চালায়, এতে হাসনাতসহ অসংখ্য ছাত্র আহত হন। এ সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সদস্যরা গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।

২. অপহরণ, পদ্মায় চাপ এবং সেইফ হাউসে আটক (১৭-১৮ জুলাই)

১৭ জুলাই রাতে হল বন্ধ থাকায় হাসনাত তার মামার বাসা (সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায়) এবং তার সঙ্গে আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম অবস্থান করছিলেন।

  • তুলে নেওয়া ও হুমকি: সেদিন রাতে ডিজিএফআই সদস্যরা পরিবারসহ ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে তাদের দুজনকে তুলে নিয়ে যায়।

  • রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা: তাদের প্রথমে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তৎকালীন তিনজন মন্ত্রী—আনিসুল হক, মোহাম্মদ এ আরাফাত ও মহিবুল হাসান নওফেল প্রবেশ করেন। ডিজিএফআই সদস্যরা টানা এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নানা প্রলোভন, ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করে তাদের মন্ত্রীদের সাথে শুধু ‘মিটিং’ করতে চাপ দেন।

  • মিটিংয়ে অস্বীকৃতি: হাসনাতসহ অন্য সমন্বয়ক নাহিদ ও আসিফের সাথে কথা না বলে তারা মিটিং করতে অস্বীকৃতি জানালে ডিজিএফআই ক্ষুব্ধ হয় এবং ওই তিনজন মন্ত্রী চলে যান।

  • সেইফ হাউসে জিজ্ঞাসাবাদ: মিটিং করতে ব্যর্থ হওয়ার পর ডিজিএফআই তাদের বাসায় ফেরত না দিয়ে মৎস্য ভবন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মাঝে একটি গোপন ‘সেইফ হাউজে’ নিয়ে আটক রাখে। সেখানে ডিজিএফআই সহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করে।

    • জিজ্ঞাসাবাদকারী ব্যক্তি সেইফ হাউজের পেছনে থাকা টিভি সেটে ডিবিসি, সময় টিভি ও একাত্তর টিভিতে ফোন করে সংবাদ পরিবর্তন ও স্ক্রল সংশোধনের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। টিভি চ্যানেলগুলো সেই অনুযায়ী সংবাদ প্রচার করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছিল।

    • জিজ্ঞাসাবাদকালে একজন সেনা কর্মকর্তা হাসনাতকে বলেন যে, তিনি ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ১০ মিনিটে বিএনপির আন্দোলন নস্যাৎ করেছিলেন এবং তাদের আন্দোলন নস্যাৎ করতেও তার সময় লাগবে না।

৩. সহ-সমন্বয়ক হাসিবের গ্রেপ্তার ও মিথ্যা প্রচার

জিজ্ঞাসাবাদকারীরা হাসনাতের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অন্য সমন্বয়কদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছিল।

  • হাসিবের গ্রেপ্তার: হাসনাতের ফোন দিয়ে একপর্যায়ে সমন্বয়ক হাসিবের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। হাসিব চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনে আছেন জানতে পারার পর ডিজিএফআই তাকেও তুলে এনে আটক রাখে।

  • শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন: হাসনাত, সারজিস ও হাসিবকে সেখানে নানাভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। হাসিব মাদরাসার ছাত্র হওয়ায় তাকে ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।

  • সংবাদ মাধ্যমে মিথ্যাচার: দেশবাসীর কাছে আন্দোলনকারীদের ‘ভিলেন’ বানানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে মিথ্যা খবর প্রচার করা হয় যে তারা সরকারের সাথে আলোচনায় বসেছেন।

  • খণ্ডিত প্রচার: যখনই তাদের মিডিয়ার সামনে আনা হতো, তারা শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিতেন। কিন্তু সময়, একাত্তর ও ডিবিসি এই বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়ায়।

৪. প্রেস কনফারেন্সের নাটকীয়তা ও ক্যান্টনমেন্টে আটক

১৮ জুলাই সন্ধ্যায় ডিজিএফআইয়ের ডিজিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সেইফ হাউজে উপস্থিত হয়ে সর্বশেষবারের মতো আন্দোলন প্রত্যাহার করতে চাপ প্রয়োগ করেন।

  • শর্তসাপেক্ষে পদ্মা: বাইরে কারও সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় হাসনাত, সারজিস ও হাসিব সিদ্ধান্ত নেন যে তাদের প্রেস কনফারেন্স করে দাবি-দাওয়া জানাতে দিলে তারা পদ্মায় যাবেন।

  • দাবি লিখিত প্রকাশ: পদ্মায় গিয়ে তারা প্রেস কনফারেন্স করে তাদের দাবি-দাওয়া লিখিতভাবে প্রকাশ করেন। তারা বারবার বলেন, তারা সরকারের সঙ্গে কোনো মিটিংয়ে আসেননি এবং তাদের শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

  • বিকৃত সংবাদ প্রচার: দুঃখজনকভাবে মিডিয়া তাদের বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে। শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করার জন্য এক সেনা কর্মকর্তা মিডিয়ার সামনেই চাপ দিলেও তারা অস্বীকৃতি জানালে সেদিন রাতে তাদের ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন, তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বিকৃতভাবে প্রচার করে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে মর্মে খবর পরিবেশিত হচ্ছে।

৫. গুম, কারফিউ ও ডিবি নির্যাতন (১৯ জুলাই – ১ আগস্ট)

  • নাহিদ গুম ও নয় দফা: ১৯ জুলাই ছাড়া পেয়ে তারা জানতে পারেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে গুম করা হয়েছে। পরে তারা নাহিদকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে খুঁজে পান। একই সময়ে আরেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ‘নয় দফা’ ঘোষণা করেন।

  • কারফিউ ও আসিফ-বাকের গুম: ১৯ জুলাই রাতে সরকার পরের দিন থেকে কারফিউ ঘোষণা করে। এরপর সমন্বয়ক আসিফ ও বাকের গুম হন। তাদের বাবা-মাকে সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। নাহিদ চাপ উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরের দিন আসিফ ও বাকেরকেও গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

  • ডিবি অফিসে অমানুষিক নির্যাতন: ২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে আসিফ, বাকের ও নাহিদকে তুলে নিয়ে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। পরদিন ২৭ জুলাই হাসনাত ও সারজিসকে এবং ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি অফিসে তুলে নেওয়া হয়।

    • হাসনাত এডিসি জুনায়েদের অধীনে ছিলেন এবং তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তাকে একবার সারারাত বাথরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন প্রত্যাহার করা।

    • এই কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করেছিলেন ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশীদ, যিনি কয়েকবার তাদের রুমে ডেকে হুমকি দেন।

    • সমন্বয়করা হাঙ্গার স্ট্রাইক করার চেষ্টা করলে ডিবি হারুন খাওয়ার ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে দেন।

  • মুক্তি: ডিবি হারুন একপর্যায়ে ছয় সমন্বয়ককে তার রুমে ডেকে এনে একটি লিখিত বর্ণনা নাহিদকে দিয়ে পাঠ করান। সেই ভিডিও প্রচার করে বলা হয় নাহিদ আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে। ১ আগস্ট দুপুর দুইটার দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার সময় তারা প্রায় ৩০ ঘণ্টাব্যাপী অনশন অবস্থায় ছিলেন। বের হয়ে এসেই তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

হাসনাত তার জবানবন্দির শেষে জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেন।