মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না—২০২৪ সালের মে মাসে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া এই যুগান্তকারী রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) শুনানির জন্য আগামী ২৮ অক্টোবর দিন নির্ধারণ করেছেন আপিল বিভাগ।
আজ (রোববার, ১৯ অক্টোবর) বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ এই দিন ধার্য করেন। আদালতে রিটকারী পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
মামলার পটভূমি ও হাইকোর্টের রায়:
২০২৪ সালের ১৩ মে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে কনডেম সেলে রাখার পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দায়ের করা একটি রিটের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির রায়ের পর জানান, হাইকোর্টের রায়ের মূল বিষয়বস্তু ও নির্দেশনাগুলো ছিল:
- মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলে রাখা যাবে না: কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি বলা যাবে না এবং তাকে মৃত্যু (কনডেম) সেলে বন্দি রাখা যাবে না। বিচারিক প্রক্রিয়া (ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও রিভিউ) এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়া (রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন) সম্পূর্ণভাবে শেষ হওয়ার পরই কেবল একজন আসামিকে মৃত্যু সেলে রাখা আইনগতভাবে বৈধ হবে।
- আলাদা সেলে রাখার ক্ষেত্রে শুনানির নির্দেশ: কোনো ব্যক্তির অসুস্থতা বা বিশেষ কারণে তাকে আলাদা সেলে রাখার প্রয়োজন হলে তার আগে তাকে নিয়ে শুনানি করতে হবে।
- নতুন আইনে প্রতিফলনের প্রত্যাশা: আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, সরকার কর্তৃক তৈরি হতে যাওয়া নতুন জেলকোড ও প্রিজন অ্যাক্টে এই রায়ের পর্যবেক্ষণ যেন প্রতিফলিত হয়, তা যেন বিবেচনা করা হয়।
- তথ্য প্রদানের নির্দেশ: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের বিষয়ে তথ্য চাইলে (সাংবাদিক, গবেষক) আইন অনুসারে তা দিতে কারা কর্তৃপক্ষ ও সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- আপিল নিষ্পত্তির তাগিদ: দুই বছরের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের ক্রমান্বয়ে কনডেম সেল থেকে সরিয়ে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
আদালত তাদের পর্যবেক্ষণে বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা ও কনডেম সেলের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিশেষভাবে সাগর-রুনির ঘটনার মতো দীর্ঘ তদন্তের কথা উল্লেখ করে আদালত বলেন:
“আমাদের দেশে ট্রায়াল স্টেজ শেষ হতে ৫-১০ বছর সময় লেগে যায়। এ ধরনের বিলম্ব যেখানে হয়, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে নির্জন সেলে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যদি বন্দি রাখা হয়, তাহলে এটি ডাবল (দ্বিগুণ) শাস্তি। নির্জন কক্ষে বসবাস তার সাজা নয়, সাজা মৃত্যুদণ্ড।”
এই রায় প্রদানে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অনুরূপ একটি রায় প্রাসঙ্গিক ভূমিকা রেখেছে বলেও আদালত উল্লেখ করেন। রিটকারী পক্ষের যুক্তি ছিল, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার পরই সাজা কার্যকর করার আইনগত কোনো বিধান নেই। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে কয়েকটি আবশ্যকীয় আইনগত ধাপ অতিক্রম করতে হয়, যেমন:
- হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও আপিল (ফৌঃ কাঃ বিঃ ৩৭৪ ও ৪১০ ধারা)।
- আপিল বিভাগে সরাসরি আপিল (সাংবিধানিক অধিকারবলে)।
- আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন (সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ)।
- রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন (সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ)।
এই সকল ধাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কনডেম সেলে রাখা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
২০২২ সালের ৫ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলে রাখা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিলেন। ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর এ রুলের ওপর শুনানি শেষ হয় এবং এরপর ১৩ মে রায় দেওয়া হয়। হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পরই রাষ্ট্রপক্ষ এর স্থগিত চেয়ে আবেদন করে এবং গত বছরের ১৫ মে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে বলা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রাষ্ট্রপক্ষ নিয়মিত লিভ টু আপিল করে, যা এখন আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ।
রিটকারী তিন আসামি—জিল্লুর রহমান, আব্দুল বশির ও শাহ আলম—বর্তমানে কনডেম সেলে বন্দি আছেন এবং তাদের আপিল হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন।
নিজস্ব প্রতিবেদক 





















