বহুল প্রতীক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদে’ স্বাক্ষর করা হলেও এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে তীব্র মতভেদ ও চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসসহ ২৪টি রাজনৈতিক দলের নেতারা এই ঐতিহাসিক সনদে স্বাক্ষর করেন, তবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় এটি মূলত একটি ‘রাজনৈতিক দলিল’ হিসেবেই থাকছে।
সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে প্রধান দলগুলোর অবস্থান ভিন্ন:
- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি): দলটি মনে করে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং একই দিনে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে বিএনপি সনদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট (দ্বিমত) দিয়েছে, যা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে তাদের অবস্থানকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী: জামায়াতের দাবি, নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সতর্ক করে বলেছেন, সরকার বিলম্ব করলে তা “জুলাইয়ের সঙ্গে জাতীয় গাদ্দারি” হিসেবে বিবেচিত হবে এবং নতুন রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করবে।
- জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি): জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী তরুণদের এই দলটি বাস্তবায়নের পদ্ধতি উল্লেখ না থাকায় সনদে স্বাক্ষর করেনি। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মন্তব্য করেছেন, আইনি ভিত্তি না থাকলে সনদ স্বাক্ষর কেবলই “লোক দেখানো এবং জুলাইয়ের সঙ্গে প্রতারণা”।
জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী দলগুলো অঙ্গীকার করলেও, এটি কার্যকরভাবে একটি রাজনৈতিক দলিল, যার কোনোরকম আইনি ভিত্তি নেই। ফলে, এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর গড়াচ্ছে। তবে সেই সংসদের ওপর এটি বাস্তবায়নের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। গণভোটের মাধ্যমে সনদ গৃহীত হলেও জাতীয় সংসদে এর অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে না, তবে বিলম্ব নতুন জটিলতা তৈরি করবে।
- অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ: তিনি বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সমস্যা হবে না যদি রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে… যারা এই জুলাই সনদ করল তারাই সংসদে যাবে। নির্বাচিত সংসদ সেসব বিষয় ঠিক করবে সিদ্ধান্ত নেবে। এগুলো রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।”
- সাজ্জাদ জহির চন্দন (সিপিবি সভাপতি): সিপিবি স্বাক্ষর না করার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সনদ বাস্তবায়নে কী সিদ্ধান্ত হবে সেটা স্পষ্ট নয়। আগে সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা সুস্পষ্ট করতে হবে। যারা ক্ষমতায় আসবে তারা কী করবে কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটাও কিন্তু স্পষ্ট নয়।”
- রাশেদ প্রধান (জাগপা সহসভাপতি): তিনি এই সনদকে একটি “অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতা” আখ্যা দিয়ে বলেন, দ্রুত সাংবিধানিক আদেশ জারি করে নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটের আয়োজন করতে হবে, অন্যথায় এটার কোনো আইনি ভিত্তি থাকবে না।
মোটকথা, সাতটি বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার সম্বলিত এই সনদটি তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অস্পষ্টতার কারণে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সমঝোতা এবং সদিচ্ছার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
নিজস্ব প্রতিবেদক 



















