আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সহ দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশজুড়ে নাশকতার ছক আঁকছে বলে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের এই অপতৎপরতা ঠেকাতে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগের এই ‘মাস্টারপ্ল্যান’ সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাদের হাতে এসেছে। মূলত পুরো পরিকল্পনাটি ভারত থেকে পরিচালিত আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাদের মিশন বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী সারা দেশে আত্মগোপনে থেকে নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই ‘ঝটিকা মিছিল’ বের করা হচ্ছে। এই চক্রের অনেককে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
নাশকতার মূল কৌশল ও লক্ষ্য:
- আন্দোলনে অনুপ্রবেশ: ভারতে থাকা ছাত্রলীগের সাবেক এক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে কোনো আন্দোলনের ইস্যুর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঢুকে পড়বে এবং সেই আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেবে। তাদের লক্ষ্য হলো আসন্ন নির্বাচনের আগে ড. ইউনূস সরকারের পতন ঘটানো।
- গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা:
- সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট করে গুপ্ত হামলা।
- চিহ্নিত ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের সংগঠিত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটানো।
- ঝটিকা মিছিলে বাধা পেলে সফলভাবে পালটা হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়া।
- হঠাৎ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে লাখো লোক জড়ো করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা: ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক জানিয়েছেন, কোনো ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে রেহাই দেওয়া হবে না। তার রেঞ্জের মধ্যে ষড়যন্ত্রকারী সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।সাইবার ইউনিটের তথ্যমতে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সাইবার স্পেসেও বড় ধরনের মিছিল আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রধান টার্গেট হলো রাজধানী ঢাকা ঘেরাও করা। তারা হঠাৎ এক ঘণ্টার ব্যবধানে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো করতে সক্রিয়। এই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ পালটা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ডিএমপি সূত্র মতে, গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে গণজমায়েতের চেষ্টা করলে ২৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের পরিকল্পনা ছিল গ্রিন রোডে জমায়েত হয়ে পান্থপথ দিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ঢুকে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার লোক জড়ো করে স্থানটি দখলে নেওয়া। পুলিশের তৎপরতায় সেটি সফল হয়নি।, গত ১১ মাসে সারা দেশ থেকে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ’-এর গোপন বৈঠক ও ষড়যন্ত্র: গত ৮ জুলাই রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার কে বি কনভেনশন সেন্টারে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীসহ ৩০০ থেকে ৪০০ জন একটি গোপন বৈঠকে অংশ নেয়।বৈঠকে পরিকল্পনা করা হয়, শেখ হাসিনার নির্দেশ পাওয়ার পর সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা ঢাকায় সমবেত হবেন এবং শাহবাগ মোড় দখল করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন। তাদের লক্ষ্য ছিল জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার ‘প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত’ করা।গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা সাজাতেই ওই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। এই ঘটনায় যুবলীগ নেতা সোহেল রানা এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন (শম্পা) গ্রেপ্তার হন। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিককে হেফাজতে নেওয়া হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকার করেছেন যে মেজর সাদিকের নির্দেশে তৃণমূল কর্মীদের নাশকতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। এই মামলায় বর্তমানে ৬৩ জন গ্রেপ্তার আছেন এবং তারা প্রত্যেকেই ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব অপতৎপরতা রুখে দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ঝটিকা মিছিলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে এবং একযোগে ২৪৪ জনকে গ্রেপ্তারের পর এ ধরনের কার্যক্রম আরও হ্রাস পেয়েছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের তৎপরতা ও সম্ভাব্য অস্থিরতা’ নিয়ে এখনই উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব থাকায় আওয়ামী লীগকে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। নির্বাচনের আগে তাদের এই কার্যক্রম থেকে সংঘাত, সহিংসতা বা নাশকতার ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নিজস্ব প্রতিবেদক 



















