সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) সহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দিদের মৃত্যুর ঘটনা এবং সেসব মৃত্যুর কারণ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক একটি গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় হাজতি বন্দি সোহাগ শিকদার (৩৪) এবং কয়েদি আইয়ুব নবীকে (৪০) কারারক্ষীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা উভয়কেই ‘ব্রট ডেড’ ঘোষণা করেন, অর্থাৎ তারা হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
মৃত বন্দিদের স্বজনরা কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। তাদের অভিযোগ, বন্দিরা অসুস্থ হওয়ার পর সঠিক সময়ে চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যার ফলে রোগের মাত্রা বেড়ে গিয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। সোহাগ শিকদারের ছোট ভাই সবুজ শিকদারের মতে, তার ভাই যক্ষ্মা (টিবি) এবং মাদকাসক্তিতে ভুগছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাকে ঢামেক-এ ভর্তি করা হয়েছিল এবং ছাড়া পাওয়ার দুই দিনের মাথায় আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। স্বজনদের দাবি, যদি প্রথম দিকেই রোগের চিকিৎসা শুরু করা হতো, তবে হয়তো তাকে বাঁচানো সম্ভব হতো। সোহাগের স্ত্রী আরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করে বলেন, তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে, যা প্রমাণ করে তাৎক্ষণিকভাবে কারাগারে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি, যদিও কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয়েছে।
একইভাবে, কয়েদি আইয়ুব নবীর ছোট ভাই গোলাম নবীর অভিযোগ, তার ভাই লিভারে পানি জমার সমস্যায় ভুগছিলেন এবং চিকিৎসার জন্য টাঙ্গাইল জেলা কারাগার থেকে ঢামেক-এ আনা হয়েছিল। তিনি জানতেও পারেননি যে আইয়ুব নবীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা আনা হয়েছে, বরং অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে তারা তার লাশ দেখতে পান। তিনি অভিযোগ করেন, আইয়ুব নবীর সঠিক চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হলে অবশ্যই পরিবারকে আগে থেকে জানানো হতো।
কারা অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগারসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে মোট ৯৫ জন বন্দি মারা গেছেন। এর মধ্যে ২২ জন হাসপাতালে নেওয়ার পথে এবং ৭৩ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এই তথ্য কারাগারে অসুস্থতার হার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
অন্যদিকে, কারা কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে ভিন্ন বক্তব্য উঠে এসেছে। কারা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশে ৭৪টি কারাগারে বন্দিদের জন্য চিকিৎসক ও চিকিৎসা-সুবিধা রয়েছে। কেরানীগঞ্জ কারাগারেও ১৭২ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে, যেখানে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার, ইসিজি, এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। সূত্রটি নিশ্চিত করেছে যে গুরুতর অসুস্থ বন্দিদের কারা চিকিৎসকদের সুপারিশে নিয়ম মেনে সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে, হাজতি (বিচারাধীন আসামি) এবং কয়েদি (সাজাপ্রাপ্ত আসামি) উভয়ই আদালতের আমানত এবং কোনো বন্দি অসুস্থ হলে কর্তৃপক্ষের অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের (কেরানীগঞ্জ) সাবেক এক কারা চিকিৎসক স্বজনদের অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি, তবে তিনি বলেছেন, চিকিৎসকরা শপথ নিয়ে তাদের পেশায় আসেন এবং তাদের লক্ষ্য রোগীকে বাঁচানো। তার মতে, গুরুতর অসুস্থদের সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়, তবে অনেক সময় রোগীর অবস্থা হঠাৎ খারাপ হওয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যু হতে পারে। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, বন্দি কারাগারে মারা গেলে সেখানেই চিকিৎসকরা তাকে ‘ডেড’ ঘোষণা করেন, এখানে জীবিত দেখিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো লুকোচুরির বিষয় নেই। তবে, বাইরে হাসপাতালে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় কিছু নিয়মের কারণে কিছুটা সময় ব্যয় হয় বলে তিনি স্বীকার করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোস্তাক আহমেদও নিশ্চিত করেছেন যে, অনেক সময় নড়াচড়া-বিহীন অবস্থায় বন্দিদের হাসপাতালে আনা হয় এবং পরীক্ষা করে দেখা যায় যে হাসপাতালে আনার আগেই তাদের মৃত্যু হয়েছে, তখন ‘ব্রট ডেড’ ঘোষণা করা হয়। তিনি আরও জানান, কারাগারে বন্দি মারা গেলে সেখানেই কর্মরত চিকিৎসকদের মৃত ঘোষণা করার কথা।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তাইবা সোহাগ শিকদার ও আইয়ুব নবীর মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন এবং উভয় ক্ষেত্রেই ‘ব্রট ডেড’ ঘোষণা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, সোহাগ তার মৃত্যুর দুই দিন আগে এবং আইয়ুব নবী মৃত্যুর কিছুদিন আগে ঢামেক থেকে ছাড়পত্র নিয়ে কারাগারে ফিরেছিলেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এই ঘটনাগুলো দেশের কারাগারগুলোতে বন্দিদের স্বাস্থ্যসেবা এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, যেখানে স্বজনদের অভিযোগ এবং কারা কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যায় এক ধরনের অসামঞ্জস্য রয়েছে। সোহাগ শিকদার ও আইয়ুব নবীর মৃত্যু এখন পুলিশের তদন্তাধীন বিষয়, যার ফলাফল এই বিতর্কের সত্যতা উদ্ঘাটনে সহায়ক হতে পারে।
নিজস্ব প্রতিবেদক 



















