০১:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫

তারকা ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস অস্তিত্বহীন ডাকঘরের কর্মচারী: মেহেরপুরে আলোচনা

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক তারকা ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস এখন মেহেরপুরের উজলপুর ডাকঘরের কাগজে-কলমে কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। এই খবরটি জানাজানি হওয়ার পর মেহেরপুরজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী যে ডাকঘরে তিনি কর্মরত, বাস্তবে সেই অফিসের কোনো অস্তিত্বই নেই।

সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, ইমরুল কায়েসের মাসিক সম্মানী মাত্র চার হাজার চারশ নব্বই (৳৪,৪৯০) টাকা। এই স্বল্প বেতনের সরকারি চাকরি নিয়েই শুরু হয়েছে নানা প্রশ্ন। স্থানীয়রা অবাক হয়ে জানতে চাইছেন—জাতীয় দলের এত বড় একজন ক্রিকেটার কি সত্যিই এই সামান্য বেতনের চাকরিজীবী, নাকি এটি প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া একটি নামমাত্র নিয়োগ?

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উজলপুর গ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ও নথিপত্র প্রেরকের কাছে ফেরত যাচ্ছে। এমনকি ফয়সাল নামের এক ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার ভিসা সংক্রান্ত কাগজও তিনি পাননি, যা যুক্তরাষ্ট্রেই ফেরত গেছে। অনেকে চাকরির সাক্ষাৎকারের চিঠিও হারিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

এমন অভিযোগের ভিত্তিতে উজলপুর গ্রামে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, গ্রামটিতে ডাকঘরের কোনো অস্তিত্বই নেই। কোথাও কোনো সাইনবোর্ড বা পোস্ট অফিসের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, “এ এলাকায় তো কোনো পোস্ট অফিস নেই।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান যে, ইমরুল কায়েসের বাবা ও দাদা আগে পোস্ট অফিস সংক্রান্ত কাজ করতেন এবং সে সময় তাদের বাড়িতেই ডাকঘর ছিল।

মেহেরপুর প্রধান ডাকঘরের রেকর্ডে দেখা যায়, উজলপুর ডাকঘরে ইমরুল কায়েস ও আব্দুল জলিল ইডিএ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল এজেন্ট) পদে এবং রাজু আহমেদ ইডিএমসি পদে কর্মরত। তবে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ জানে না তারা কারা বা কোথায় আছেন। জানা গেছে, জলিল নামে একজন চিঠি বিলি করতেন, কিন্তু এখন তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ইমরুল কায়েস বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার একটি ক্রিকেট একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন

মেহেরপুর প্রধান ডাকঘরের পোস্টমাস্টার জহুরুল ইসলাম এই বিষয়ে বলেন, ইমরুল কায়েস প্রায় চার-পাঁচ বছর হলো ডাক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তিনি ইমরুলকে এলাকার সন্তান ও তারকা ক্রিকেটার হিসেবে উল্লেখ করে তার সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু না লেখার অনুরোধ করেন।

বিভাগীয় ডাক পরিদর্শক অলক কুমার বিশ্বাস নিশ্চিত করেছেন, ২০২১ সালে তৎকালীন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ডিও (Demi-Official letter) অনুযায়ী ইমরুল কায়েসকে উজলপুর ডাকঘরের ইডিএ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি জানান, মাসিক সম্মানী ৪,৫০০ টাকা এবং এটি লাভজনক কোনো পদ নয়। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, যে ডাকঘর বাস্তবে নেই, সেখানে কীভাবে সরকারি নিয়োগ কার্যকর থাকে।

ইমরুল কায়েস অস্ট্রেলিয়া থেকে মোবাইল ফোনে এই বিষয়ে কালবেলা প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন এবং ডাক বিভাগে তার সম্পৃক্ততা ও সাম্প্রতিক সময়ে চিঠি ফেরত যাওয়ার ঘটনাটি অকপটে স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, “গ্রাম পোস্টমাস্টারদের কাজ চিঠি বিলি করা না। আমি পোস্ট অফিসের অনুরোধে তাদের সঙ্গে আমার নামটি যুক্ত করেছি, যাতে বাংলাদেশের ডাক বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে।” যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি ফেরত যাওয়ার বিষয়টি তিনি পোস্টম্যানের ভুল বলে দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, ইডিএ জলিল এখন ওমরাহ করতে সৌদি আরব অবস্থান করছেন এবং দেশে ফিরলেই সমস্যার সমাধান করবেন।

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ আবদুল সালাম জানান, বিষয়টি তার জানা ছিল না। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন এবং সত্যতা মিললে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।

স্থানীয়দের অনেকেই এই নিয়োগ নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের বক্তব্য, ইমরুল কায়েস দেশের একজন সফল ক্রিকেটার এবং তার পরিবারও প্রভাবশালী (তার শ্বশুর মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং শীর্ষ ঠিকাদার)। এমন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে সুযোগ না দিয়ে গ্রামের কোনো দরিদ্র ছেলেকে এ পদে নিয়োগ দেওয়াটা কতটা ন্যায্য, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

উল্লেখ্য, ইমরুল কায়েসের দাদা কায়েম বিশ্বাস পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমবঙ্গে নদিয়া থেকে মেহেরপুরে বসতি গড়েন। তার দাদা ও বাবা দুজনেই গ্রাম পোস্টমাস্টার হিসেবে কাজ করেছেন। ইমরুলের বাবা বনি আমিন বিশ্বাস ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।

জনপ্রিয়

স্বাধীনতার সুফল আমরা ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি : মামুনুল হক

তারকা ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস অস্তিত্বহীন ডাকঘরের কর্মচারী: মেহেরপুরে আলোচনা

প্রকাশিত : ০৮:২৬:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক তারকা ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস এখন মেহেরপুরের উজলপুর ডাকঘরের কাগজে-কলমে কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। এই খবরটি জানাজানি হওয়ার পর মেহেরপুরজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী যে ডাকঘরে তিনি কর্মরত, বাস্তবে সেই অফিসের কোনো অস্তিত্বই নেই।

সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, ইমরুল কায়েসের মাসিক সম্মানী মাত্র চার হাজার চারশ নব্বই (৳৪,৪৯০) টাকা। এই স্বল্প বেতনের সরকারি চাকরি নিয়েই শুরু হয়েছে নানা প্রশ্ন। স্থানীয়রা অবাক হয়ে জানতে চাইছেন—জাতীয় দলের এত বড় একজন ক্রিকেটার কি সত্যিই এই সামান্য বেতনের চাকরিজীবী, নাকি এটি প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া একটি নামমাত্র নিয়োগ?

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উজলপুর গ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ও নথিপত্র প্রেরকের কাছে ফেরত যাচ্ছে। এমনকি ফয়সাল নামের এক ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার ভিসা সংক্রান্ত কাগজও তিনি পাননি, যা যুক্তরাষ্ট্রেই ফেরত গেছে। অনেকে চাকরির সাক্ষাৎকারের চিঠিও হারিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

এমন অভিযোগের ভিত্তিতে উজলপুর গ্রামে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, গ্রামটিতে ডাকঘরের কোনো অস্তিত্বই নেই। কোথাও কোনো সাইনবোর্ড বা পোস্ট অফিসের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, “এ এলাকায় তো কোনো পোস্ট অফিস নেই।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান যে, ইমরুল কায়েসের বাবা ও দাদা আগে পোস্ট অফিস সংক্রান্ত কাজ করতেন এবং সে সময় তাদের বাড়িতেই ডাকঘর ছিল।

মেহেরপুর প্রধান ডাকঘরের রেকর্ডে দেখা যায়, উজলপুর ডাকঘরে ইমরুল কায়েস ও আব্দুল জলিল ইডিএ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল এজেন্ট) পদে এবং রাজু আহমেদ ইডিএমসি পদে কর্মরত। তবে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ জানে না তারা কারা বা কোথায় আছেন। জানা গেছে, জলিল নামে একজন চিঠি বিলি করতেন, কিন্তু এখন তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ইমরুল কায়েস বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার একটি ক্রিকেট একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন

মেহেরপুর প্রধান ডাকঘরের পোস্টমাস্টার জহুরুল ইসলাম এই বিষয়ে বলেন, ইমরুল কায়েস প্রায় চার-পাঁচ বছর হলো ডাক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তিনি ইমরুলকে এলাকার সন্তান ও তারকা ক্রিকেটার হিসেবে উল্লেখ করে তার সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু না লেখার অনুরোধ করেন।

বিভাগীয় ডাক পরিদর্শক অলক কুমার বিশ্বাস নিশ্চিত করেছেন, ২০২১ সালে তৎকালীন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ডিও (Demi-Official letter) অনুযায়ী ইমরুল কায়েসকে উজলপুর ডাকঘরের ইডিএ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি জানান, মাসিক সম্মানী ৪,৫০০ টাকা এবং এটি লাভজনক কোনো পদ নয়। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, যে ডাকঘর বাস্তবে নেই, সেখানে কীভাবে সরকারি নিয়োগ কার্যকর থাকে।

ইমরুল কায়েস অস্ট্রেলিয়া থেকে মোবাইল ফোনে এই বিষয়ে কালবেলা প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন এবং ডাক বিভাগে তার সম্পৃক্ততা ও সাম্প্রতিক সময়ে চিঠি ফেরত যাওয়ার ঘটনাটি অকপটে স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, “গ্রাম পোস্টমাস্টারদের কাজ চিঠি বিলি করা না। আমি পোস্ট অফিসের অনুরোধে তাদের সঙ্গে আমার নামটি যুক্ত করেছি, যাতে বাংলাদেশের ডাক বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে।” যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি ফেরত যাওয়ার বিষয়টি তিনি পোস্টম্যানের ভুল বলে দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, ইডিএ জলিল এখন ওমরাহ করতে সৌদি আরব অবস্থান করছেন এবং দেশে ফিরলেই সমস্যার সমাধান করবেন।

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ আবদুল সালাম জানান, বিষয়টি তার জানা ছিল না। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন এবং সত্যতা মিললে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।

স্থানীয়দের অনেকেই এই নিয়োগ নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের বক্তব্য, ইমরুল কায়েস দেশের একজন সফল ক্রিকেটার এবং তার পরিবারও প্রভাবশালী (তার শ্বশুর মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং শীর্ষ ঠিকাদার)। এমন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে সুযোগ না দিয়ে গ্রামের কোনো দরিদ্র ছেলেকে এ পদে নিয়োগ দেওয়াটা কতটা ন্যায্য, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

উল্লেখ্য, ইমরুল কায়েসের দাদা কায়েম বিশ্বাস পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমবঙ্গে নদিয়া থেকে মেহেরপুরে বসতি গড়েন। তার দাদা ও বাবা দুজনেই গ্রাম পোস্টমাস্টার হিসেবে কাজ করেছেন। ইমরুলের বাবা বনি আমিন বিশ্বাস ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।