বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বর্তমানে কেবল একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীর ব্যক্তিগত সংকট নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল মানবিক ও আবেগময় দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে। গত ২৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) দেশের কোটি মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত জটিল; লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতাসহ একাধিক অসুস্থতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চিকিৎসকরা যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
🩺 আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসার জটিলতা
৮০ বছর বয়সী এই প্রবীণ রাজনীতিকের চিকিৎসা চলছে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে। লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র এবং সম্প্রতি চীন থেকে আসা পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দল তাঁর মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নেওয়ার প্রস্তুতি (এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ) থাকলেও, তাঁর শরীরের অস্থিতিশীলতার কারণে বিমানে ওঠার ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘ সময়ের জন্য বিমানে ভ্রমণ বা কেবিন প্রেশারের তারতম্য তাঁর পক্ষে সহ্য করা প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘদিনের সুচিকিৎসার অভাব এবং কারাবাসের ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি আজকের এই গভীর সংকটের দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এভারকেয়ারের চিকিৎসকরা তাঁকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, যাতে অন্তত বিদেশে যাওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা আসে।
📢 গুজব, আতঙ্ক ও নেতাদের তড়িৎ হস্তক্ষেপ
সোমবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে হঠাৎ করেই রাজধানীসহ দেশজুড়ে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে খবর আসে যে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হয়েছে এবং তাঁকে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে) স্থানান্তর করে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়া হয়েছে। এই গুজব মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়।এই পরিস্থিতিতে জনমনে ‘সিসিইউ’, ‘লাইফ সাপোর্ট’ এবং ‘ভেন্টিলেশন’ শব্দগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক তৈরি হয়।
-
সিসিইউ (CCU): করোনারি কেয়ার ইউনিট, যা মূলত হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য। এখানে রোগীর হৃৎস্পন্দন ও রক্তচাপ সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয় এবং রোগী সাধারণত সজ্ঞান থাকেন। বেগম জিয়া হৃদরোগে ভোগার কারণে এখানে চিকিৎসাধীন।
-
লাইফ সাপোর্ট: এটি কোনো একক মেশিন নয়, বরং এটি একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া, যেখানে শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ (যেমন: হার্ট, কিডনি, ফুসফুস) কাজ করতে ব্যর্থ হলে কৃত্রিম উপায়ে সেই অঙ্গের কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়। এর মধ্যে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ বা ডায়ালাইসিসও অন্তর্ভুক্ত।
-
ভেন্টিলেশন: ভেন্টিলেটর বা কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসের কাজ করানো, যা লাইফ সাপোর্টের একটি অংশ হতে পারে।
এই গুজব খণ্ডাতে দলের শীর্ষ নেতারা তাৎক্ষণিকভাবে মাঠে নামেন। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উভয়েই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানান যে, বেগম খালেদা জিয়া সিসিইউতেই আছেন এবং তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে, তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়নি। দলের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ছাড়া অন্য কারও বক্তব্য বা গুজবে কান না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
❤️ জনসমর্থন ও আবেগের নজিরবিহীন বিস্ফোরণ
অসুস্থতার এই সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি দল-মত নির্বিশেষে মানুষের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ভালোবাসা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। হাসপাতালের বাইরে শত শত সাধারণ মানুষ রাত-দিন অপেক্ষা করছেন, যাদের অনেকেই সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। এটি প্রমাণ করে, তিনি আর কেবল একটি দলের নেত্রী নন, বরং বাংলাদেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর আবেগের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
গত কয়েকদিনে দেশের প্রায় প্রতিটি মসজিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর রোগমুক্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে আবেগ ও সহানুভূতির বিস্ফোরণ। একসময়ের কঠোর সমালোচক বা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষও তাঁর সুস্থতা কামনা করে পোস্ট দিচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মানবিক ঢেউয়ের কারণ তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ‘নীরব সহ্যশক্তি’। দীর্ঘদিন ধরে কারাবাস, অসুস্থতা এবং চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়ায় তিনি জনগণের চোখে এক ‘মজলুম জননেত্রী’ বা ‘ট্র্যাজিক হিরো’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন।
তাঁর প্রতি মানুষের এই ভালোবাসা নেলসোন ম্যান্ডেলা, বেনজির ভুট্টো বা কোরাজন অ্যাকুইনোর মতো বিশ্বনেতাদের সঙ্গে পরিস্থিতির বিচারে কিছু মিল খুঁজে পাওয়ার সুযোগ করে দেয়, যারা প্রতিকূলতার মুখেও জনগণের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন। তাঁর এই নজিরবিহীন জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক বিভেদ সত্ত্বেও তাঁর প্রতি মানুষের এক ধরণের সুপ্ত শ্রদ্ধা এবং মমতা কাজ করে।
🇧🇩 তারেক রহমানের দেশে না ফেরা: দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা
এই কঠিন সময়েও বেগম খালেদা জিয়া দেশপ্রেম ও দূরদর্শী নেতৃত্বের এক চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরতে ব্যাকুল হলেও, খোদ বেগম খালেদা জিয়াই চান না তাঁর ছেলে এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে দেশে ফিরুক। তিনি আশঙ্কা করেছেন যে, এই মুহূর্তে তারেক রহমান ফিরলে স্বার্থান্বেষী মহল পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পারে, যা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হবে। নিজের একমাত্র জীবিত সন্তানকে শেষবারের মতো দেখার আকুতি বুকে চেপে রেখেও তিনি দেশের স্বার্থে ছেলেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন—যা তাঁকে কেবল একজন মা নয়, বরং একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর প্রতি এই গণসমর্থনই প্রমাণ করে, বাস্তব জনপ্রিয়তা ক্ষমতা দিয়ে নয়, ত্যাগ দিয়ে অর্জিত হয়।
মাহবুব মুনীর 





















