০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

সাধারণ গৃহিণী থেকে রাজনীতির শীর্ষে বেগম খালেদা জিয়া: আপসহীন সংগ্রামের এক নজিরবিহীন উত্থান

বেগম খালেদা জিয়ার জীবন কেবল একজন রাজনৈতিক নেত্রীর উত্থানের গল্প নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, আপসহীন সংগ্রাম এবং জনসমর্থনের জোরে একজন সাধারণ গৃহবধূর রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হওয়ার এক অনন্য উপাখ্যান। তিনি রাজনীতির ব্যাকরণ ভেঙে, স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পর সৃষ্ট শূন্যতাকে পূরণ করে, মাত্র কয়েক বছরেই দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেন এবং তিনবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন। তাঁর এই যাত্রা এক কথায় নজিরবিহীন।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান একটি অসাধারণ গল্প, যা একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব, এমনকি বিশ্বের দ্বিতীয় নারী মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যাত্রা চিত্রিত করে। তাঁর এই পথ মসৃণ ছিল না, বরং ছিল আপসহীন সংগ্রাম, ত্যাগ এবং জনগণের প্রতি অঙ্গীকারের এক দুর্গম পথ।

১. সামরিক অফিসারের স্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি: রাজনীতির বাইরের জীবন

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু হওয়ার আগে কেটেছে একজন সামরিক অফিসারের স্ত্রী হিসেবে। তিনি ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী। যখন জিয়াউর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি (১৯৭৭-১৯৮১), তখন তিনি বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই সময়েও তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে ছিলেন। তাঁর ধ্যান-ধারণা ছিল পারিবারিক এবং ঘরোয়া। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তাঁর এই গৃহিণীসুলভ সরলতা এবং পরবর্তীকালের দৃঢ়তা—এই দুই বিপরীত গুণাবলীই তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

২. রাজনীতির আকস্মিক আহ্বান: ১৯৮১ সালের ট্র্যাজেডি

তাঁর জীবনে রাজনীতির আকস্মিক আগমন ঘটে এক চরম ট্র্যাজেডির মাধ্যমে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আততায়ীর হাতে নিহত হন। স্বামীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয়তাবাদী শক্তি চরম নেতৃত্বশূন্যতায় পড়ে। এরপরই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। দলের অস্তিত্ব ও গণতন্ত্রের সংকটে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার অনিবার্য প্রয়োজন থেকেই তাঁর রাজনীতিতে আসা।

  • প্রাথমিক পদক্ষেপ: স্বামীর আদর্শ ও প্রতিষ্ঠিত দলকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই তিনি ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন।

  • নেতৃত্ব গ্রহণ: রাজনীতিতে তাঁর আগমন দ্রুতই নেতৃত্ব গ্রহণের পর্যায়ে পৌঁছায়। দলে তাঁর জনপ্রিয়তা ও দৃঢ়তা অল্প সময়েই তাঁকে সবার উপরে নিয়ে আসে। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং মাত্র দুই বছরের মধ্যে ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। এইভাবে, স্বামীর প্রয়াণের পর তিনি কেবল তাঁর উত্তরাধিকার বহন করেননি, বরং নিজেই দলের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন।

৩. স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে “আপসহীন নেত্রী” উপাধি (১৯৮৩-১৯৯০)

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থানের মূল ভিত্তি হলো এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘ নয় বছরের সংগ্রাম। এই সময়ে তাঁর ভূমিকা তাঁকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে জনগণের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে দেয়।

  • সাতদলীয় জোট গঠন: সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে বিএনপির নেতৃত্বে সাতদলীয় জোট গঠন করেন এবং রাস্তায় নেমে আসেন।

  • সংগ্রামের কৌশল: তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, সামরিক স্বৈরশাসনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তিনি এরশাদ সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা আপসে রাজি হননি। তাঁর এই কঠোর অবস্থান স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

  • অসংখ্যবার গ্রেপ্তার ও গৃহবন্দী: আন্দোলন চলাকালীন তাঁকে বারবার ভয়ভীতি, হুমকি এবং কারাবাসের মুখোমুখি হতে হয়। আট বছরে তাঁকে সাতবার গ্রেপ্তার করা হয় বা গৃহবন্দী রাখা হয়। কিন্তু কোনো দমন-পীড়নই তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে এক চুলও সরাতে পারেনি।

  • গণতন্ত্রের বিজয়: তাঁর নেতৃত্বাধীন জোটের লাগাতার এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জোটের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে। এই বিজয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে তিনি একজন অবিস্মরণীয় নেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন।

৪. বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও ঐতিহাসিক সংস্কার (১৯৯১)

স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

  • ইতিহাস সৃষ্টি: ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে তিনি মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী (বেনজির ভুট্টোর পর) হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

  • সংসদীয় পদ্ধতির প্রবর্তন: প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বাংলাদেশের শাসন পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা। তাঁর সরকার ১৯৯১ সালের ঐতিহাসিক দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে। এটি ছিল তাঁর গণতন্ত্রের প্রতি গভীর আস্থার বহিঃপ্রকাশ।

  • শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব: তাঁর প্রথম মেয়াদে শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল: অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষা ও উপবৃত্তি প্রদান। এই নীতি নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা বিস্তারে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

৫. দীর্ঘমেয়াদী সংকট ও জননেত্রীতে রূপান্তর

২০০১-২০০৬ মেয়াদে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর, ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন (১/১১) সামরিক সমর্থিত সরকারের সময় থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নতুন করে দীর্ঘমেয়াদী সংকট শুরু হয়।

  • দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা: ১/১১ এর সময় তাঁকে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য প্রবল চাপ দেওয়া হলেও তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর এই উক্তি — “দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশ, এই দেশের মাটি-মানুষই আমার সবকিছু” — তাঁকে জনগণের কাছে দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

  • ব্যক্তিগত ক্ষতি ও আইনি লড়াই: পরবর্তী সময়ে তিনি আইনি জটিলতা, দীর্ঘদিন কারাবাস, স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকালমৃত্যুর মতো ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির শিকার হন।

  • জনগণের আবেগের কেন্দ্রবিন্দু: এই দীর্ঘ ত্যাগ, ব্যক্তিগত ক্ষতি এবং অসুস্থ শরীরে কারাবাস তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের এক গভীর সহানুভূতি সৃষ্টি করেছে। রাজনীতি ছাড়িয়ে একজন মজলুম মা এবং নেত্রী হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি তাঁকে দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর আবেগের প্রতীকে পরিণত করেছে। জনগণ মনে করে, এতগুলো ঝড় সহ্য করার কারণে তিনি আজ আর কেবল একটি দলের নেত্রী নন, বরং গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগের এক জীবন্ত উদাহরণ।

তাঁর এই পুরো জীবনযাত্রা প্রমাণ করে যে, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা সুবিধা নয়, বরং আপসহীন মানসিকতা, জনগণের জন্য সহ্যশক্তি এবং গভীর দেশপ্রেম একজন সাধারণ মানুষকেও ইতিহাসের শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে।

জনপ্রিয়

ড. এজাজুল ইসলাম: অভিনয় ও চিকিৎসার বিরল সমন্বয়

সাধারণ গৃহিণী থেকে রাজনীতির শীর্ষে বেগম খালেদা জিয়া: আপসহীন সংগ্রামের এক নজিরবিহীন উত্থান

প্রকাশিত : ০২:৪৬:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫

বেগম খালেদা জিয়ার জীবন কেবল একজন রাজনৈতিক নেত্রীর উত্থানের গল্প নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, আপসহীন সংগ্রাম এবং জনসমর্থনের জোরে একজন সাধারণ গৃহবধূর রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হওয়ার এক অনন্য উপাখ্যান। তিনি রাজনীতির ব্যাকরণ ভেঙে, স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পর সৃষ্ট শূন্যতাকে পূরণ করে, মাত্র কয়েক বছরেই দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেন এবং তিনবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন। তাঁর এই যাত্রা এক কথায় নজিরবিহীন।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান একটি অসাধারণ গল্প, যা একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব, এমনকি বিশ্বের দ্বিতীয় নারী মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যাত্রা চিত্রিত করে। তাঁর এই পথ মসৃণ ছিল না, বরং ছিল আপসহীন সংগ্রাম, ত্যাগ এবং জনগণের প্রতি অঙ্গীকারের এক দুর্গম পথ।

১. সামরিক অফিসারের স্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি: রাজনীতির বাইরের জীবন

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু হওয়ার আগে কেটেছে একজন সামরিক অফিসারের স্ত্রী হিসেবে। তিনি ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী। যখন জিয়াউর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি (১৯৭৭-১৯৮১), তখন তিনি বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই সময়েও তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে ছিলেন। তাঁর ধ্যান-ধারণা ছিল পারিবারিক এবং ঘরোয়া। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তাঁর এই গৃহিণীসুলভ সরলতা এবং পরবর্তীকালের দৃঢ়তা—এই দুই বিপরীত গুণাবলীই তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

২. রাজনীতির আকস্মিক আহ্বান: ১৯৮১ সালের ট্র্যাজেডি

তাঁর জীবনে রাজনীতির আকস্মিক আগমন ঘটে এক চরম ট্র্যাজেডির মাধ্যমে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আততায়ীর হাতে নিহত হন। স্বামীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয়তাবাদী শক্তি চরম নেতৃত্বশূন্যতায় পড়ে। এরপরই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। দলের অস্তিত্ব ও গণতন্ত্রের সংকটে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার অনিবার্য প্রয়োজন থেকেই তাঁর রাজনীতিতে আসা।

  • প্রাথমিক পদক্ষেপ: স্বামীর আদর্শ ও প্রতিষ্ঠিত দলকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই তিনি ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন।

  • নেতৃত্ব গ্রহণ: রাজনীতিতে তাঁর আগমন দ্রুতই নেতৃত্ব গ্রহণের পর্যায়ে পৌঁছায়। দলে তাঁর জনপ্রিয়তা ও দৃঢ়তা অল্প সময়েই তাঁকে সবার উপরে নিয়ে আসে। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং মাত্র দুই বছরের মধ্যে ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। এইভাবে, স্বামীর প্রয়াণের পর তিনি কেবল তাঁর উত্তরাধিকার বহন করেননি, বরং নিজেই দলের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন।

৩. স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে “আপসহীন নেত্রী” উপাধি (১৯৮৩-১৯৯০)

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থানের মূল ভিত্তি হলো এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘ নয় বছরের সংগ্রাম। এই সময়ে তাঁর ভূমিকা তাঁকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে জনগণের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে দেয়।

  • সাতদলীয় জোট গঠন: সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে বিএনপির নেতৃত্বে সাতদলীয় জোট গঠন করেন এবং রাস্তায় নেমে আসেন।

  • সংগ্রামের কৌশল: তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, সামরিক স্বৈরশাসনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তিনি এরশাদ সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা আপসে রাজি হননি। তাঁর এই কঠোর অবস্থান স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

  • অসংখ্যবার গ্রেপ্তার ও গৃহবন্দী: আন্দোলন চলাকালীন তাঁকে বারবার ভয়ভীতি, হুমকি এবং কারাবাসের মুখোমুখি হতে হয়। আট বছরে তাঁকে সাতবার গ্রেপ্তার করা হয় বা গৃহবন্দী রাখা হয়। কিন্তু কোনো দমন-পীড়নই তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে এক চুলও সরাতে পারেনি।

  • গণতন্ত্রের বিজয়: তাঁর নেতৃত্বাধীন জোটের লাগাতার এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জোটের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে। এই বিজয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে তিনি একজন অবিস্মরণীয় নেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন।

৪. বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও ঐতিহাসিক সংস্কার (১৯৯১)

স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

  • ইতিহাস সৃষ্টি: ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে তিনি মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী (বেনজির ভুট্টোর পর) হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

  • সংসদীয় পদ্ধতির প্রবর্তন: প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বাংলাদেশের শাসন পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা। তাঁর সরকার ১৯৯১ সালের ঐতিহাসিক দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে। এটি ছিল তাঁর গণতন্ত্রের প্রতি গভীর আস্থার বহিঃপ্রকাশ।

  • শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব: তাঁর প্রথম মেয়াদে শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল: অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষা ও উপবৃত্তি প্রদান। এই নীতি নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা বিস্তারে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

৫. দীর্ঘমেয়াদী সংকট ও জননেত্রীতে রূপান্তর

২০০১-২০০৬ মেয়াদে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর, ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন (১/১১) সামরিক সমর্থিত সরকারের সময় থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নতুন করে দীর্ঘমেয়াদী সংকট শুরু হয়।

  • দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা: ১/১১ এর সময় তাঁকে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য প্রবল চাপ দেওয়া হলেও তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর এই উক্তি — “দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশ, এই দেশের মাটি-মানুষই আমার সবকিছু” — তাঁকে জনগণের কাছে দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

  • ব্যক্তিগত ক্ষতি ও আইনি লড়াই: পরবর্তী সময়ে তিনি আইনি জটিলতা, দীর্ঘদিন কারাবাস, স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকালমৃত্যুর মতো ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির শিকার হন।

  • জনগণের আবেগের কেন্দ্রবিন্দু: এই দীর্ঘ ত্যাগ, ব্যক্তিগত ক্ষতি এবং অসুস্থ শরীরে কারাবাস তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের এক গভীর সহানুভূতি সৃষ্টি করেছে। রাজনীতি ছাড়িয়ে একজন মজলুম মা এবং নেত্রী হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি তাঁকে দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর আবেগের প্রতীকে পরিণত করেছে। জনগণ মনে করে, এতগুলো ঝড় সহ্য করার কারণে তিনি আজ আর কেবল একটি দলের নেত্রী নন, বরং গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগের এক জীবন্ত উদাহরণ।

তাঁর এই পুরো জীবনযাত্রা প্রমাণ করে যে, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা সুবিধা নয়, বরং আপসহীন মানসিকতা, জনগণের জন্য সহ্যশক্তি এবং গভীর দেশপ্রেম একজন সাধারণ মানুষকেও ইতিহাসের শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে।