০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

ভূমিকম্প: বাংলাদেশে আতঙ্ক, ঝুঁকি ও প্রস্তুতি

ভূমিকম্প (Earthquake) বাংলাদেশের চলমান যাপিত জীবনে এক ভয়ংকর আতঙ্কের নাম। গত ২১ নভেম্বর, ২০২৫, শুক্রবার নরসিংদীর মাধবদীতে সৃষ্ট ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প এবং এরপরে দফায় দফায় সৃষ্ট ছোট কম্পনগুলো এই আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা কোনো পূর্ব সংকেত ছাড়াই প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম।

⚡️ ভূমিকম্প কী এবং কেন হয়?

সাধারণভাবে ভূমিকম্প বলতে যে কোনো ধরনের ভূকম্পনজনিত ঘটনাকে বোঝায়, যা প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণে হতে পারে।

১. ভূমিকম্পের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি

ভূমিকম্প হলো ভূত্বকের উপরে বা নিচে শিলাস্তরের স্থিতিশীলতার বা অভিকর্ষীয় ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটার ফলে ভূপৃষ্ঠে সৃষ্ট আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পন।

  • উৎপত্তি: ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলায় ক্রমাগত পীড়নের ফলে সঞ্চিত শক্তি হঠাৎ মুক্তি পেলে এই কম্পন সৃষ্টি হয়। এই শক্তি কম্পন-তরঙ্গ আকারে ভূ-গর্ভের একটি নির্দিষ্ট উৎসস্থল (কেন্দ্র বা হাইপোসেন্টার) থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

  • স্থায়িত্ব: ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে ১-২ মিনিট স্থায়ী হয়, যদিও খুব কম সংখ্যক ক্ষেত্রে এটি ৮-১০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

২. ভূমিকম্পের প্রধান কারণ

ভূমিকম্প মূলত তিনটি প্রধান কারণে উৎপত্তি হয়ে থাকে: ভূগর্ভে ফাটল ও স্তরচ্যুতি হওয়া, ভূ-অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটসমূহের সংঘর্ষ, স্থানচ্যুতি বা ঘর্ষণ, আগ্নেয়গিরির উদগীরণের সময় সৃষ্ট কম্পন।এছাড়াও তাপ বিকিরণ, ভূগর্ভস্থ বাষ্প, ভূমিধস, ভূপাত, খনিতে বিস্ফোরণ বা ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষানিরীক্ষা থেকেও ভূমিকম্প হতে পারে।

৩. টেকটোনিক প্লেটের ভূমিকা

Getty Images

পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০-১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার প্রায় ১৯-২০টি অনমনীয় টেকটোনিক প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। উত্তপ্ত ও নরম এস্থোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান এ প্লেটগুলো প্রতিনিয়ত গতিশীল।

  • সংঘর্ষ ও শক্তি সঞ্চয়: টেকটোনিক প্লেটগুলো পরস্পরের সঙ্গে লেগে থাকে। যখন এই প্লেটগুলো কনভেকশন কারেন্টের প্রভাবে স্থানচ্যুত হয় এবং একটি প্লেটের কোনো অংশ অপরটির নিচে ঢুকে যায় (সাবডাকশন), তখন প্রচণ্ড ঘর্ষণের ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়।

  • সিসমিক তরঙ্গ: সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যথেষ্ট শক্তিশালী হলে ভূ-ত্বককে কাঁপিয়ে তোলে।


📏 ভূমিকম্পের পরিমাপ ও শ্রেণিবিভাগ

ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য দুটি প্রধান পরিমাপক ব্যবহৃত হয়:

  • সিসমোগ্রাফ: ভূমিকম্পের তরঙ্গ বা কম্পন রেকর্ড করে।

  • রিখটার স্কেল: ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণায়ক যন্ত্র (এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত)।

১. মাত্রার ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ (রিখটার স্কেল অনুযায়ী)

রিখটার স্কেলে মাত্রা প্রকৃতি
৫ – ৫.৯৯ মাঝারি (Moderate)
৬ – ৬.৯৯ তীব্র (Strong)
৭ – ৭.৯৯ ভয়াবহ (Major)
৮ এর ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ (Great)

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে এর শক্তি প্রায় ১০ থেকে ৩২ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

২. উৎসের গভীরতা অনুসারে শ্রেণিবিভাগ

উৎসের গভীরতা প্রকারভেদ
৭০ কিলোমিটারের মধ্যে অগভীর ভূমিকম্প (Shallow)
৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে মধ্যবর্তী ভূমিকম্প (Intermediate)
৩০০ কিলোমিটারের নিচে গভীর ভূমিকম্প (Deep)

🌊 ভূমিকম্পের ফলাফল ও ভয়াবহতা

তীব্র ভূমিকম্প প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াও নানা ধরনের ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে:

  • ভূ-ত্বকে ফাটল ও চ্যুতি: ভূ-ত্বকে অসংখ্য ফাটল বা চ্যুতির সৃষ্টি হয়।

  • দ্বীপ সৃষ্টি/বিলীন: সমুদ্রতলের অনেক স্থান উপরে ভেসে উঠে দ্বীপের সৃষ্টি হতে পারে, আবার স্থলভাগের অনেক স্থান সমুদ্রে বিলীন হতে পারে।

  • নদীর গতিপথ পরিবর্তন: নদীর গতিপথ পরিবর্তিত বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

  • সুনামি: তীব্র ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রের তলদেশে বিশাল স্থানচ্যুতি ঘটলে তা প্রচণ্ড গর্জনসহ ১৫-২০ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আকারে উপকূলে আছড়ে পড়ে, যা সুনামি নামে পরিচিত।

  • ফোরশক ও আফটার শক: মূল ভূমিকম্পের পূর্বে ছোট কম্পনগুলোকে ফোরশক এবং পরে সৃষ্ট ছোট কম্পনগুলোকে আফটার শক বলা হয়।

🇧🇩 বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান ও ঝুঁকি

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ অত্যন্ত ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত।

১. টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান

বাংলাদেশ ‘আলপাইন-হিমালয়ান’ অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত এবং এটি তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে: ইন্ডিয়ান প্লেট,ইউরেশীয় প্লেট,বার্মা প্লেট

ইন্ডিয়ান প্লেটটি ইউরেশীয় প্লেটকে (উত্তরে) এবং বার্মিজ প্লেটকে (পূর্বে) ক্রমান্বয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। এই সংঘর্ষের ফলে বিগত প্রায় ৪০০ বছর ধরে ইন্ডিয়ান-বার্মা টেকটোনিক প্লেটে চাপ জমে উঠছে, যা মুক্তি পেলে প্রায় ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে।

২. ঝুঁকিপূর্ণ ফল্ট জোন

বাংলাদেশের ভূমিকম্পনের প্রধান উৎস দুটি:

  1. উত্তরাঞ্চলীয় ডাউকি ফল্ট জোন: যা হিমালয়ের পাদদেশ এলাকায় অবস্থিত।

  2. পূর্বাঞ্চলীয় সাবডাকশন জোন (ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন): এটি দুটি ভাগে বিভক্ত। ‘লকড জোন’ (সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ থেকে ভারতের মণিপুর-মিজোরাম অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত) বর্তমানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো শক্তি সঞ্চিত করে আছে।

এছাড়াও, দেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বগুড়া চ্যুতি, তানোর চ্যুতি, ত্রিপুরা চ্যুতি, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ চ্যুতি এবং সিলেট-মেঘালয় সীমান্তের ডাউকি চ্যুতি এলাকা।

৩. ভূ-কম্পন এলাকাভিত্তিক মানচিত্র

প্রায় ৬২ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের তীব্রতার ভিত্তিতে নিম্নলিখিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে:

ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এলাকা (শতাংশ) উদাহরণ
জোন-১ (উচ্চ ঝুঁকি) ৪৩% পঞ্চগড়, রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ।
জোন-২ (মধ্যম ঝুঁকি) ৪১% রাজশাহী, নাটোর, কুমিল্লা, ফেনী এবং ঢাকা।
জোন-৩ (নিম্ন ঝুঁকি) ১৬% বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সকল দ্বীপ ও চর।

৪. ঢাকার ঝুঁকি

ভূ-তাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম।

  • ঝুঁকির কারণ: ঢাকার ভূ-ত্বক নরম পাললিক শিলার সমন্বয়ে গঠিত এবং জলাভূমি ভরাট করে আবাসন এলাকা গড়ে ওঠায় ভূমিকম্পের সময় কম্পন তরঙ্গ বহুগুণ বেড়ে যায়।

  • ক্ষয়ক্ষতি: ঢাকা জোন-২ এ থাকলেও, এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে (যেমন মধুপুর: ৬০ কিমি দূরে) ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা থাকায় এবং অধিকাংশ ভবন ভূমিকম্পসহনীয় কোড অনুসারে নির্মিত না হওয়ায়, তীব্র ভূমিকম্পে ঢাকার প্রায় ৮০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


🚨 সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় করণীয়

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক:

  • সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ: ভূমিকম্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং মহড়ার মাধ্যমে সকল স্তরের মানুষকে প্রশিক্ষিত করে তোলা।

  • ভবন নির্মাণ কোড: বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ অনুসারে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা।

  • ঝুঁকিপূর্ণ ভবন: ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণ বা রেট্রো ফিটিংয়ের ব্যবস্থা করা।

  • শহর বিকেন্দ্রীকরণ: রাজধানী ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রয়োজনে কম ভূমিকম্পন প্রবণ অঞ্চলে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা।

  • আন্তঃদেশীয় প্রস্তুতি: বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও চীনের মতো প্লেটের সাংঘর্ষিকস্থলে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে আন্তঃদেশীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

জনপ্রিয়

ড. এজাজুল ইসলাম: অভিনয় ও চিকিৎসার বিরল সমন্বয়

ভূমিকম্প: বাংলাদেশে আতঙ্ক, ঝুঁকি ও প্রস্তুতি

প্রকাশিত : ০৩:৪১:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫

ভূমিকম্প (Earthquake) বাংলাদেশের চলমান যাপিত জীবনে এক ভয়ংকর আতঙ্কের নাম। গত ২১ নভেম্বর, ২০২৫, শুক্রবার নরসিংদীর মাধবদীতে সৃষ্ট ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প এবং এরপরে দফায় দফায় সৃষ্ট ছোট কম্পনগুলো এই আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা কোনো পূর্ব সংকেত ছাড়াই প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম।

⚡️ ভূমিকম্প কী এবং কেন হয়?

সাধারণভাবে ভূমিকম্প বলতে যে কোনো ধরনের ভূকম্পনজনিত ঘটনাকে বোঝায়, যা প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণে হতে পারে।

১. ভূমিকম্পের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি

ভূমিকম্প হলো ভূত্বকের উপরে বা নিচে শিলাস্তরের স্থিতিশীলতার বা অভিকর্ষীয় ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটার ফলে ভূপৃষ্ঠে সৃষ্ট আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পন।

  • উৎপত্তি: ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলায় ক্রমাগত পীড়নের ফলে সঞ্চিত শক্তি হঠাৎ মুক্তি পেলে এই কম্পন সৃষ্টি হয়। এই শক্তি কম্পন-তরঙ্গ আকারে ভূ-গর্ভের একটি নির্দিষ্ট উৎসস্থল (কেন্দ্র বা হাইপোসেন্টার) থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

  • স্থায়িত্ব: ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে ১-২ মিনিট স্থায়ী হয়, যদিও খুব কম সংখ্যক ক্ষেত্রে এটি ৮-১০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

২. ভূমিকম্পের প্রধান কারণ

ভূমিকম্প মূলত তিনটি প্রধান কারণে উৎপত্তি হয়ে থাকে: ভূগর্ভে ফাটল ও স্তরচ্যুতি হওয়া, ভূ-অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটসমূহের সংঘর্ষ, স্থানচ্যুতি বা ঘর্ষণ, আগ্নেয়গিরির উদগীরণের সময় সৃষ্ট কম্পন।এছাড়াও তাপ বিকিরণ, ভূগর্ভস্থ বাষ্প, ভূমিধস, ভূপাত, খনিতে বিস্ফোরণ বা ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষানিরীক্ষা থেকেও ভূমিকম্প হতে পারে।

৩. টেকটোনিক প্লেটের ভূমিকা

Getty Images

পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০-১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার প্রায় ১৯-২০টি অনমনীয় টেকটোনিক প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। উত্তপ্ত ও নরম এস্থোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান এ প্লেটগুলো প্রতিনিয়ত গতিশীল।

  • সংঘর্ষ ও শক্তি সঞ্চয়: টেকটোনিক প্লেটগুলো পরস্পরের সঙ্গে লেগে থাকে। যখন এই প্লেটগুলো কনভেকশন কারেন্টের প্রভাবে স্থানচ্যুত হয় এবং একটি প্লেটের কোনো অংশ অপরটির নিচে ঢুকে যায় (সাবডাকশন), তখন প্রচণ্ড ঘর্ষণের ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়।

  • সিসমিক তরঙ্গ: সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যথেষ্ট শক্তিশালী হলে ভূ-ত্বককে কাঁপিয়ে তোলে।


📏 ভূমিকম্পের পরিমাপ ও শ্রেণিবিভাগ

ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য দুটি প্রধান পরিমাপক ব্যবহৃত হয়:

  • সিসমোগ্রাফ: ভূমিকম্পের তরঙ্গ বা কম্পন রেকর্ড করে।

  • রিখটার স্কেল: ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণায়ক যন্ত্র (এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত)।

১. মাত্রার ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ (রিখটার স্কেল অনুযায়ী)

রিখটার স্কেলে মাত্রা প্রকৃতি
৫ – ৫.৯৯ মাঝারি (Moderate)
৬ – ৬.৯৯ তীব্র (Strong)
৭ – ৭.৯৯ ভয়াবহ (Major)
৮ এর ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ (Great)

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে এর শক্তি প্রায় ১০ থেকে ৩২ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

২. উৎসের গভীরতা অনুসারে শ্রেণিবিভাগ

উৎসের গভীরতা প্রকারভেদ
৭০ কিলোমিটারের মধ্যে অগভীর ভূমিকম্প (Shallow)
৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে মধ্যবর্তী ভূমিকম্প (Intermediate)
৩০০ কিলোমিটারের নিচে গভীর ভূমিকম্প (Deep)

🌊 ভূমিকম্পের ফলাফল ও ভয়াবহতা

তীব্র ভূমিকম্প প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াও নানা ধরনের ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে:

  • ভূ-ত্বকে ফাটল ও চ্যুতি: ভূ-ত্বকে অসংখ্য ফাটল বা চ্যুতির সৃষ্টি হয়।

  • দ্বীপ সৃষ্টি/বিলীন: সমুদ্রতলের অনেক স্থান উপরে ভেসে উঠে দ্বীপের সৃষ্টি হতে পারে, আবার স্থলভাগের অনেক স্থান সমুদ্রে বিলীন হতে পারে।

  • নদীর গতিপথ পরিবর্তন: নদীর গতিপথ পরিবর্তিত বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

  • সুনামি: তীব্র ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রের তলদেশে বিশাল স্থানচ্যুতি ঘটলে তা প্রচণ্ড গর্জনসহ ১৫-২০ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আকারে উপকূলে আছড়ে পড়ে, যা সুনামি নামে পরিচিত।

  • ফোরশক ও আফটার শক: মূল ভূমিকম্পের পূর্বে ছোট কম্পনগুলোকে ফোরশক এবং পরে সৃষ্ট ছোট কম্পনগুলোকে আফটার শক বলা হয়।

🇧🇩 বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান ও ঝুঁকি

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ অত্যন্ত ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত।

১. টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান

বাংলাদেশ ‘আলপাইন-হিমালয়ান’ অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত এবং এটি তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে: ইন্ডিয়ান প্লেট,ইউরেশীয় প্লেট,বার্মা প্লেট

ইন্ডিয়ান প্লেটটি ইউরেশীয় প্লেটকে (উত্তরে) এবং বার্মিজ প্লেটকে (পূর্বে) ক্রমান্বয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। এই সংঘর্ষের ফলে বিগত প্রায় ৪০০ বছর ধরে ইন্ডিয়ান-বার্মা টেকটোনিক প্লেটে চাপ জমে উঠছে, যা মুক্তি পেলে প্রায় ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে।

২. ঝুঁকিপূর্ণ ফল্ট জোন

বাংলাদেশের ভূমিকম্পনের প্রধান উৎস দুটি:

  1. উত্তরাঞ্চলীয় ডাউকি ফল্ট জোন: যা হিমালয়ের পাদদেশ এলাকায় অবস্থিত।

  2. পূর্বাঞ্চলীয় সাবডাকশন জোন (ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন): এটি দুটি ভাগে বিভক্ত। ‘লকড জোন’ (সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ থেকে ভারতের মণিপুর-মিজোরাম অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত) বর্তমানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো শক্তি সঞ্চিত করে আছে।

এছাড়াও, দেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বগুড়া চ্যুতি, তানোর চ্যুতি, ত্রিপুরা চ্যুতি, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ চ্যুতি এবং সিলেট-মেঘালয় সীমান্তের ডাউকি চ্যুতি এলাকা।

৩. ভূ-কম্পন এলাকাভিত্তিক মানচিত্র

প্রায় ৬২ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের তীব্রতার ভিত্তিতে নিম্নলিখিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে:

ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এলাকা (শতাংশ) উদাহরণ
জোন-১ (উচ্চ ঝুঁকি) ৪৩% পঞ্চগড়, রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ।
জোন-২ (মধ্যম ঝুঁকি) ৪১% রাজশাহী, নাটোর, কুমিল্লা, ফেনী এবং ঢাকা।
জোন-৩ (নিম্ন ঝুঁকি) ১৬% বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সকল দ্বীপ ও চর।

৪. ঢাকার ঝুঁকি

ভূ-তাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম।

  • ঝুঁকির কারণ: ঢাকার ভূ-ত্বক নরম পাললিক শিলার সমন্বয়ে গঠিত এবং জলাভূমি ভরাট করে আবাসন এলাকা গড়ে ওঠায় ভূমিকম্পের সময় কম্পন তরঙ্গ বহুগুণ বেড়ে যায়।

  • ক্ষয়ক্ষতি: ঢাকা জোন-২ এ থাকলেও, এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে (যেমন মধুপুর: ৬০ কিমি দূরে) ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা থাকায় এবং অধিকাংশ ভবন ভূমিকম্পসহনীয় কোড অনুসারে নির্মিত না হওয়ায়, তীব্র ভূমিকম্পে ঢাকার প্রায় ৮০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


🚨 সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় করণীয়

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক:

  • সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ: ভূমিকম্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং মহড়ার মাধ্যমে সকল স্তরের মানুষকে প্রশিক্ষিত করে তোলা।

  • ভবন নির্মাণ কোড: বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ অনুসারে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা।

  • ঝুঁকিপূর্ণ ভবন: ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণ বা রেট্রো ফিটিংয়ের ব্যবস্থা করা।

  • শহর বিকেন্দ্রীকরণ: রাজধানী ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রয়োজনে কম ভূমিকম্পন প্রবণ অঞ্চলে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা।

  • আন্তঃদেশীয় প্রস্তুতি: বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও চীনের মতো প্লেটের সাংঘর্ষিকস্থলে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে আন্তঃদেশীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা।