অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং শপথ পাঠের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট খারিজের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দেওয়ার পর দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা মন্তব্য করেছেন যে, এই আদেশের ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম, বিশেষ করে তাদের নির্ধারিত ‘নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার’ এই তিনটি ম্যান্ডেট সংক্রান্ত বৈধতার বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।
বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বেঞ্চ এই বহুল প্রতীক্ষিত আদেশটি দেন।
⚖️ অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে হাইকোর্টের রায়ের মধ্যে কোনো প্রকার ভ্রান্তি, ভুল বা বেআইনি কিছু ছিল না। এই কারণেই তাঁরা লিভ টু আপিলটি পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দিয়েছেন। তবে তিনি জানান, পর্যবেক্ষণটি কী, তা বিস্তারিত জানার জন্য লিখিত আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
🏛️ আইনজীবীদের বিশ্লেষণ: ‘জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অভিপ্রায়’ প্রতিষ্ঠা
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এই আদেশকে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবেই দেখছেন:
-
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল মন্তব্য করেন যে, আজকের আদেশের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে রিটের কোনো সারবত্তা বা গুরুত্ব আর রইল না। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, “প্রকারান্তরে অন্তর্বর্তী সরকার যে পরিচালিত হচ্ছে জনগণের মতামতের ঐকমত্যের ভিত্তিতে, সেটাই স্থাপিত হলো।”
-
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির এই রায়কে ‘উইল অব দ্য পিপল’ বা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অভিপ্রায় এর প্রতিষ্ঠা হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “বর্তমান সরকারের বৈধতার প্রশ্নে হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে দায়ের করা লিভ টু আপিলে আজ আদেশ হলো। এই আদেশটি সর্বসম্মতিতে হয়েছে।” তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন যে, এই সরকার যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, তা মূলত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই করছে।
🎯 ম্যান্ডেটের বৈধতা এবং সাংবিধানিক শূন্যতার অবসান
আইনজীবী শিশির মনির বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেন, উচ্চ আদালত এই আদেশের মাধ্যমে দেশের সংবিধানের মূলমন্ত্রকে আবার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, এই আদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো:
“এই আদেশের ফলে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে তিনটি ম্যান্ডেট—নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার—সম্পর্কিত বৈধতার ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।”
তিনি আরও মন্তব্য করেন, যে সাংবিধানিক শূন্যতা (ভ্যাকুয়াম) নিয়ে অনেকে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, আজকের সুপ্রিম কোর্টের সর্বসম্মত আদেশের মাধ্যমে সেই শূন্যতার আর কোনো অবকাশ রইল না।
📜 প্রেক্ষাপট: সাংবিধানিক পথরেখা
এই আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল মূলত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ (সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার) অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়ে রেফারেন্স পাঠান।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত বছরের ৮ আগস্ট মতামত দেন যে, সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত ও শপথ পাঠ করাতে পারবেন।
এই মতামতের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ রিট দায়ের করেন। হাইকোর্ট চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি সেই রিট খারিজ করে দেন, এই বলে যে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গৃহীত সুপ্রিম কোর্টের মতামত এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার দ্বারা সমর্থিত এবং রিটটি ছিল ভ্রান্ত ধারণা, বিদ্বেষপ্রসূত ও হয়রানিমূলক। হাইকোর্টের সেই আদেশের বিরুদ্ধেই লিভ টু আপিল করা হয়েছিল, যা বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগ খারিজ করে দেন।
নিজস্ব প্রতিবেদক 























