রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল এখন আর কেবল একটি চিকিৎসালয় নয়, এটি পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের কোটি মানুষের আবেগ, উৎকণ্ঠা এবং সম্মিলিত প্রার্থনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত ২৩ নভেম্বর থেকে এই হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চিকিৎসাধীন। লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনি জটিলতার মতো বহুবিধ রোগে আক্রান্ত এই নেত্রীর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চীন ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দলসহ দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছে। লন্ডন থেকে জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন এবং পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। কিন্তু হাসপাতালের চার দেওয়ালের বাইরের চিত্রটি এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে।
😭 জনস্রোত: রাজনীতির ঊর্ধ্বে এক আবেগ
গত ২৮ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে হাসপাতালের সামনে মানুষের ঢল নেমেছে। এটি কোনো রাজনৈতিক শো-ডাউন বা স্লোগানের জায়গা নয়; এটি কেবলই সম্মিলিত দোয়া, উদ্বেগ ও নিস্তব্ধ আবেগের এক মিলনক্ষেত্র।সরেজমিনে দেখা যায়, বাড্ডা থেকে আসা রিকশাচালক মফিজুল ইসলাম থেকে শুরু করে গুলশানের গৃহিণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এমনকি বিদেশ থেকে ফেরা প্রবাসী বাংলাদেশি জামিল আহমেদ পর্যন্ত সমাজের সকল স্তরের মানুষ হাসপাতালের গেটের বাইরে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের হাতে কোনো ব্যানার নেই, কিন্তু চোখেমুখে আছে গভীর উদ্বেগ। এই নজিরবিহীন জনসমাগম প্রমাণ করে, বেগম খালেদা জিয়া আজ আর কেবল একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী নন, তিনি আপামর জনসাধারণের আবেগের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
💡 আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি গঠনে বেগম জিয়ার অবদান
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি জনগণের এই গভীর শ্রদ্ধা একদিনে তৈরি হয়নি। ১৯৮১ সালে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি রাজনীতিতে এসে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী ৯ বছরের আন্দোলনে নিজেকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন।
তার শাসনামলের কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল:
-
নারী শিক্ষার প্রসার: তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা এবং মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখার জন্য ‘উপবৃত্তি প্রথা’ প্রবর্তন করা। আজকের বাংলাদেশে নারী জাগরণের ভিত্তি এখানেই রচিত হয়েছিল।
-
অর্থনৈতিক সংস্কার: ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রবর্তন তার অন্যতম সাহসী পদক্ষেপ, যা আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির দুয়ার খুলে দেওয়া এবং বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার নীতি তার আমলেই বেগবান হয়।
-
পরিবেশ ও সমাজ: পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করা এবং ঢাকার বাতাস পরিষ্কার রাখতে টু-স্ট্রোক অটোরিকশা তুলে দিয়ে সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালু করার মতো অগ্রসর সিদ্ধান্তও তার আমলেই নেওয়া হয়েছিল।
-
গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন: ১৯৯১ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এক ঐতিহাসিক বিল পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এক মাইলফলক। এছাড়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত (ত্রয়োদশ সংশোধনী) করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথও তিনি সুগম করেছিলেন।
✨ ভিভিআইপি মর্যাদা ও এসএসএফ সুরক্ষা: বিরল স্বীকৃতি
বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা এতটাই সংকটাপন্ন যে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করেও বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া যাচ্ছে না। তবুও সৌদি আরব, চীন, কাতারসহ বিশ্ব বহু উন্নত দেশ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এদিকে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা প্রদর্শন করছে। সরকার ইতোমধ্যে তাকে ‘রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ (ভিভিআইপি) হিসেবে ঘোষণা করে বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এবং তার নিরাপত্তার দায়িত্ব স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সদস্যদের ওপর অর্পণ করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী/প্রধান উপদেষ্টার বাইরে থাকা কোনো ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এমন ভিভিআইপি মর্যাদা ও এসএসএফ সুরক্ষা দেওয়ার নজির বিরল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘ বঞ্চনার পর এটি একজন জাতীয় নেত্রীর প্রাপ্য সম্মানের স্বীকৃতি।
💔 অপপ্রচার ও নির্যাতনের মুখে আপসহীনতা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১৫ বছরে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ, মিথ্যা অপবাদ এবং কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তাকে ‘মেট্রিক ফেল’ বা ‘এইট পাশ’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে দীর্ঘদিন জেলে রাখা হয়। এছাড়াও শেখ হাসিনার শাসনামলে তার উপর মধ্যযুগীয় নির্যাতন করা হয়েছে—যেমন:
-
৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ।
-
গুলশান কার্যালয়ে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা এবং বিদ্যুৎ, পানি, খাবার সরবরাহ বন্ধ করা।
-
ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সময় অবরুদ্ধ থাকা।
-
পদ্মা সেতু নিয়ে সমালোচনার জবাবে তাকে ‘টুস করে ফেলে দেওয়া উচিত’ বলে মন্তব্য করা।
কিন্তু এসব চরম নির্যাতনের জবাবে বেগম খালেদা জিয়া কখনোই একটি কটু কথাও বলেননি। তার এই পরিমার্জিত বোধ ও সহনশীলতা আজ তাকে সাধারণ মানুষের চোখে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করেছে।
🕊️ প্রতিহিংসাহীন নেতৃত্ব ও ইতিহাসের বিচার
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসেবে উল্লেখ করছেন। বেগম খালেদা জিয়াকে অপদস্তকারী শেখ হাসিনা গণরোষের মুখে লাঞ্ছিত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভিনদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, আর যে খালেদা জিয়াকে তিনি নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন, তিনি আজ মৃত্যুশয্যায় শুয়েও কোটি মানুষের প্রার্থনায় সিক্ত হচ্ছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতনের পর মুক্তি পেয়ে বেগম খালেদা জিয়া তার ষণে ‘ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়’—এই বার্তা দিয়েছিলেন। সেসময় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বন্ধে দলীয় নেতাকর্মীদের মন্দির ও গির্জা পাহারা দেওয়ার নির্দেশ দেন, যা ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশকে এক বড় ধরনের গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক ভুলের ঊর্ধ্বে না হলেও, গত দেড় দশকে তিনি যে চরম ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, বিশেষ করে দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার যে নজির তিনি ১/১১-এর সময় এবং পরবর্তীকালে স্থাপন করেছেন, তা তার অতীতের সব ত্রুটিকে ছাপিয়ে গেছে। জনগণ আজ তাকে তার ভুলের জন্য নয়, বরং দেশপ্রেম ও আপসহীন ত্যাগের জন্য শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এভারকেয়ারের বাইরের এই জনস্রোতই প্রমাণ করে, তিনি আজ ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন।
নিজস্ব প্রতিবেদক 
























