০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর নতুন রণকৌশল: ‘নতুন মুখ, পেশাগত বৈচিত্র্য ও জোটের সমীকরণ’

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী তাদের চিরায়ত নির্বাচনী ধারা থেকে বেরিয়ে এসে এক ভিন্ন রণকৌশল অবলম্বন করছে। এই কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনা, পেশাগত বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা এবং বৃহত্তর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা। দলটি শুধু আসন্ন সংসদ নির্বাচনই নয়, বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রস্তুতির দিকে মনোনিবেশ করেছে।


🌟 প্রার্থী মনোনয়নে বৈচিত্র্য ও নতুন মুখের সমাগম

জামায়াত ৩০০ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরেও বিভিন্ন আসনে পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলো হলো:

জামায়াত প্রথাগত রাজনৈতিক প্রার্থীর ধারণাকে অতিক্রম করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবীদের প্রাধান্য দিচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এসব পেশাজীবী ও অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত মুখেরা ক্লিন ইমেজের কারণে ভোটারদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পাবেন। দলের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রার্থীরই এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা নেই।

নতুন প্রার্থীরা বেশিরভাগই তরুণ এবং শিক্ষিত, যাদের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করার আশা করছে দলীয় নেতৃত্ব।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, জামায়াত প্রথমবারের মতো অমুসলিম প্রার্থী (হিন্দু সম্প্রদায়) বিবেচনায় নেওয়ার চিন্তা করছে। খুলনা-১ আসনে কৃষ্ণ নন্দী নামে সনাতন ধর্মের একজন নেতাকে নির্বাচনী মাঠে কাজের ইশারা দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, এটি জামায়াতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার এবং বৃহত্তর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের ইঙ্গিত দেয়।

সম্প্রতি হবিগঞ্জ-৪, লালমনিরহাট-৩ এবং সিলেট-১ আসনে এমপি প্রার্থী পরিবর্তন করে নতুন মুখ যুক্ত করা হয়েছে। যেমন, লালমনিরহাট-৩ আসনে অ্যাডভোকেট আবু তাহেরকে নতুন প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। হবিগঞ্জ-৪ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী মুখলিছুর রহমান সরে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে সমর্থন জানিয়েছেন।


🤝 জোটগত সমীকরণ ও কৌশলগত পরিবর্তন

নির্বাচনী সমঝোতা এবং জোটের রাজনীতি জামায়াতের কৌশলগত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। জামায়াত প্রায় আটটি সমমনা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। যদি এই সমঝোতা কার্যকর হয়, তবে জামায়াতকে অন্তত ৫০টি আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে। এই পরিবর্তন হবে সম্পূর্ণ কৌশলগত—জোটের শরিকদের ছাড় দিতে এবং জয় নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন যোগ্য প্রার্থীকে নতুনভাবে মনোনয়ন দিতে। এই ক্ষেত্রে জয়ের সম্ভাবনা যার বেশি, প্রার্থী যে দলেরই হোক না কেন, তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।৩০০ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণার মাধ্যমে জামায়াত স্থানীয় সাংগঠনিক শক্তি এবং জনগণের মনোভাব পরিমাপ করেছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে দুর্বল প্রার্থীদের সরিয়ে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আসা হচ্ছে।


🏞️ স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি

জামায়াত কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে না, বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের এরই মধ্যে প্রস্তুতির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে তা তৃণমূল পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করবে এবং সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটাতে সাহায্য করবে। সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা পরিষদে নতুন প্রার্থীরা দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হিসেবে প্রস্তুত হতে পারবেন।


🎙️ দায়িত্বশীল নেতাদের বক্তব্য

মাওলানা আবদুল হালিম (সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল) নিশ্চিত করেছেন যে, স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও সাংগঠনিক কারণে এবং জোটগত সমঝোতার জন্য কিছু আসনে প্রার্থিতায় পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য আসবে।অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের (সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল) জানান, আগাম পরিকল্পনা অনুযায়ী জনপ্রিয় এবং পেশাজীবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অসুস্থতা এবং সাংগঠনিক কারণেও প্রার্থিতায় পরিবর্তন আসছে। উদাহরণস্বরূপ, সিলেট-১ আসনে তিনি নিজে প্রার্থী থাকলেও কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় সেখানে মাওলানা হাবিবুর রহমানকে নতুনভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদেরও কাজের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জামায়াতের এই নতুন কৌশল এবং বৈচিত্র্যময় নতুন মুখ রাজনীতি ও ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত কতটা প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

জনপ্রিয়

ড. এজাজুল ইসলাম: অভিনয় ও চিকিৎসার বিরল সমন্বয়

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর নতুন রণকৌশল: ‘নতুন মুখ, পেশাগত বৈচিত্র্য ও জোটের সমীকরণ’

প্রকাশিত : ০১:৩৭:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী তাদের চিরায়ত নির্বাচনী ধারা থেকে বেরিয়ে এসে এক ভিন্ন রণকৌশল অবলম্বন করছে। এই কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনা, পেশাগত বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা এবং বৃহত্তর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা। দলটি শুধু আসন্ন সংসদ নির্বাচনই নয়, বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রস্তুতির দিকে মনোনিবেশ করেছে।


🌟 প্রার্থী মনোনয়নে বৈচিত্র্য ও নতুন মুখের সমাগম

জামায়াত ৩০০ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরেও বিভিন্ন আসনে পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলো হলো:

জামায়াত প্রথাগত রাজনৈতিক প্রার্থীর ধারণাকে অতিক্রম করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবীদের প্রাধান্য দিচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এসব পেশাজীবী ও অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত মুখেরা ক্লিন ইমেজের কারণে ভোটারদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পাবেন। দলের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রার্থীরই এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা নেই।

নতুন প্রার্থীরা বেশিরভাগই তরুণ এবং শিক্ষিত, যাদের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করার আশা করছে দলীয় নেতৃত্ব।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, জামায়াত প্রথমবারের মতো অমুসলিম প্রার্থী (হিন্দু সম্প্রদায়) বিবেচনায় নেওয়ার চিন্তা করছে। খুলনা-১ আসনে কৃষ্ণ নন্দী নামে সনাতন ধর্মের একজন নেতাকে নির্বাচনী মাঠে কাজের ইশারা দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, এটি জামায়াতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার এবং বৃহত্তর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের ইঙ্গিত দেয়।

সম্প্রতি হবিগঞ্জ-৪, লালমনিরহাট-৩ এবং সিলেট-১ আসনে এমপি প্রার্থী পরিবর্তন করে নতুন মুখ যুক্ত করা হয়েছে। যেমন, লালমনিরহাট-৩ আসনে অ্যাডভোকেট আবু তাহেরকে নতুন প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। হবিগঞ্জ-৪ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী মুখলিছুর রহমান সরে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে সমর্থন জানিয়েছেন।


🤝 জোটগত সমীকরণ ও কৌশলগত পরিবর্তন

নির্বাচনী সমঝোতা এবং জোটের রাজনীতি জামায়াতের কৌশলগত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। জামায়াত প্রায় আটটি সমমনা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। যদি এই সমঝোতা কার্যকর হয়, তবে জামায়াতকে অন্তত ৫০টি আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে। এই পরিবর্তন হবে সম্পূর্ণ কৌশলগত—জোটের শরিকদের ছাড় দিতে এবং জয় নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন যোগ্য প্রার্থীকে নতুনভাবে মনোনয়ন দিতে। এই ক্ষেত্রে জয়ের সম্ভাবনা যার বেশি, প্রার্থী যে দলেরই হোক না কেন, তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।৩০০ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণার মাধ্যমে জামায়াত স্থানীয় সাংগঠনিক শক্তি এবং জনগণের মনোভাব পরিমাপ করেছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে দুর্বল প্রার্থীদের সরিয়ে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আসা হচ্ছে।


🏞️ স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি

জামায়াত কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে না, বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের এরই মধ্যে প্রস্তুতির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে তা তৃণমূল পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করবে এবং সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটাতে সাহায্য করবে। সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা পরিষদে নতুন প্রার্থীরা দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হিসেবে প্রস্তুত হতে পারবেন।


🎙️ দায়িত্বশীল নেতাদের বক্তব্য

মাওলানা আবদুল হালিম (সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল) নিশ্চিত করেছেন যে, স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও সাংগঠনিক কারণে এবং জোটগত সমঝোতার জন্য কিছু আসনে প্রার্থিতায় পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য আসবে।অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের (সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল) জানান, আগাম পরিকল্পনা অনুযায়ী জনপ্রিয় এবং পেশাজীবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অসুস্থতা এবং সাংগঠনিক কারণেও প্রার্থিতায় পরিবর্তন আসছে। উদাহরণস্বরূপ, সিলেট-১ আসনে তিনি নিজে প্রার্থী থাকলেও কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় সেখানে মাওলানা হাবিবুর রহমানকে নতুনভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদেরও কাজের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জামায়াতের এই নতুন কৌশল এবং বৈচিত্র্যময় নতুন মুখ রাজনীতি ও ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত কতটা প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।