০৯:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত

খেলাপি ঋণের সময়সীমা কমানোয় শিল্প ও বাণিজ্য খাতে তীব্র সংকট: উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ

দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক মান ‘ব্যাসেল-৩’ কার্যকর করায় অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। নতুন এই মান অনুযায়ী, ঋণের কিস্তি পরপর তিনবার পরিশোধ না করলেই গ্রাহক খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন, যা আগে ছয় মাস ছিল। উদ্যোক্তারা এই পরিবর্তনকে তাঁদের জন্য একটি বড় বিপদ হিসেবে দেখছেন।

ব্যাসেল-৩ প্রয়োগ এবং সংকটের কারণ

  • খেলাপি হওয়ার সময়সীমা হ্রাস: আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে ব্যাংকিং খাতে এই মান অনুসরণ করা হচ্ছে, যেখানে খেলাপি হওয়ার সময়সীমা ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে।
  • আর্থিক খাতের অপ্রস্তুতি: উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের আর্থিক খাতকে পুরোপুরি প্রস্তুত না করেই এবং অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম না করেই এই আন্তর্জাতিক মান কার্যকর করা হয়েছে।
  • অর্থনৈতিক অস্থিরতা: ঋণের উচ্চ সুদ হার, রিজার্ভ হ্রাস, ডলারের বিপরীতে টাকার বড় পতন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য এমনিতেই সংকটের মধ্যে ছিল। এমন অবস্থায় খেলাপি হওয়ার সময়সীমা কমানোয় সংকট আরও গভীর হচ্ছে।
  • তুলনা: নীট তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক এটিকে ‘দুর্বল শিক্ষার্থীকে পাস করানোর ব্যবস্থা না করে পাসের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে বিপদে ফেলে দেওয়ার মতো’ বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, ঋণ খেলাপি হওয়ার মূল কারণ চিহ্নিত না করে এই উদ্যোগ নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হয়নি।

উদ্যোক্তাদের ক্ষোভ ও দাবি

  • বিজনেস সিস্টেমের ভিন্নতা: ফজলুল হক বলেন, দেশের বিজনেস ও ঋণ ব্যবস্থাপনা বিশ্বমানের না হতেই আদায়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান কার্যকর করা হয়েছে। যারা ঋণ বিদেশে পাচার করে এবং যারা যৌক্তিক কারণে ব্যবসা করতে পারেনি, তাদের এক পাল্লায় মাপা ঠিক নয়।
  • ভালো ব্যবসায়ীদের সমস্যা: তিনি উল্লেখ করেন, অনেক ভালো ব্যবসায়ী কষ্ট করে টিকে থাকলেও সময়সীমা কমানোর ফলে এখন নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন এবং ঋণ পাচ্ছেন না।
  • দেউলিয়াত্ব ও বেকারত্বের শঙ্কা: ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, সতর্কতা ছাড়া ব্যাসেল-৩ হঠাৎ প্রয়োগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতে পারে। এতে দেউলিয়া ব্যবসার সংখ্যা বাড়বে, যা অর্থনীতিতে অস্থিরতা ও বেকারত্ব সৃষ্টি করতে পারে।
  • সিআইবিতে প্রভাব: সিআইবিতে (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) খেলাপি হিসেবে নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়বে। একবার তালিকাভুক্ত হলে তাদের অন্যান্য কোম্পানিও ঋণ পাবে না এবং খেলাপির ঝুঁকিতে পড়বে।
  • পুনর্বিবেচনার দাবি: আশরাফ আহমেদ সিআইবিতে খেলাপি চিহ্নিত করার নিয়ম পুনর্বিবেচনা, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ঋণ পুনর্গঠন ও সুদ মওকুফের সুযোগ এবং প্রয়োজনে দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার দাবি জানান।
  • বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর করুণ দশা: বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল ব্যাংক খাতকে আগে ঠিক করার এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় গড়ে ওঠা ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর আহ্বান জানান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে এখন একমাত্র মুনাফাকারী ব্যাংক হলো বাংলাদেশ ব্যাংক।

খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চিত্র

  • রেকর্ড খেলাপি ঋণ: দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সর্বশেষ জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ শতাংশের ওপরে বলে জানা গেছে (যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এই তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি)।
  • মার্চ প্রান্তিকের তথ্য: মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ।
  • প্রভিশন ঘাটতির ঝুঁকি: খেলাপি ঋণ বাড়লে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ডাউটফুল ও ব্যাড অ্যান্ড লস ঋণের বিপরীতে ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। অনেক ব্যাংক এখনি তা সংরক্ষণ করতে পারছে না। খেলাপি ঋণ আরও বাড়লে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকের সংখ্যা বাড়বে, যার প্রভাব বিনিয়োগকারীদের ওপর পড়বে।
  • সুদের বোঝা বৃদ্ধি: এই অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণের কারণে আগের সময়ের খেলাপিদের ঋণের বোঝাসহ বাড়তি সুদের বোঝা তুলনামূলক ভালো গ্রাহকদের ওপর চাপানো হচ্ছে।
  • সরকার পতনের সময়ের চিত্র: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, হাসিনা সরকারের পতনের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯.৯৭ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশ হয়েছে।
জনপ্রিয়

স্বাধীনতার সুফল আমরা ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি : মামুনুল হক

অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত

খেলাপি ঋণের সময়সীমা কমানোয় শিল্প ও বাণিজ্য খাতে তীব্র সংকট: উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ

প্রকাশিত : ০৩:২৮:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫

দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক মান ‘ব্যাসেল-৩’ কার্যকর করায় অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। নতুন এই মান অনুযায়ী, ঋণের কিস্তি পরপর তিনবার পরিশোধ না করলেই গ্রাহক খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন, যা আগে ছয় মাস ছিল। উদ্যোক্তারা এই পরিবর্তনকে তাঁদের জন্য একটি বড় বিপদ হিসেবে দেখছেন।

ব্যাসেল-৩ প্রয়োগ এবং সংকটের কারণ

  • খেলাপি হওয়ার সময়সীমা হ্রাস: আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে ব্যাংকিং খাতে এই মান অনুসরণ করা হচ্ছে, যেখানে খেলাপি হওয়ার সময়সীমা ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে।
  • আর্থিক খাতের অপ্রস্তুতি: উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের আর্থিক খাতকে পুরোপুরি প্রস্তুত না করেই এবং অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম না করেই এই আন্তর্জাতিক মান কার্যকর করা হয়েছে।
  • অর্থনৈতিক অস্থিরতা: ঋণের উচ্চ সুদ হার, রিজার্ভ হ্রাস, ডলারের বিপরীতে টাকার বড় পতন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য এমনিতেই সংকটের মধ্যে ছিল। এমন অবস্থায় খেলাপি হওয়ার সময়সীমা কমানোয় সংকট আরও গভীর হচ্ছে।
  • তুলনা: নীট তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক এটিকে ‘দুর্বল শিক্ষার্থীকে পাস করানোর ব্যবস্থা না করে পাসের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে বিপদে ফেলে দেওয়ার মতো’ বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, ঋণ খেলাপি হওয়ার মূল কারণ চিহ্নিত না করে এই উদ্যোগ নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হয়নি।

উদ্যোক্তাদের ক্ষোভ ও দাবি

  • বিজনেস সিস্টেমের ভিন্নতা: ফজলুল হক বলেন, দেশের বিজনেস ও ঋণ ব্যবস্থাপনা বিশ্বমানের না হতেই আদায়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান কার্যকর করা হয়েছে। যারা ঋণ বিদেশে পাচার করে এবং যারা যৌক্তিক কারণে ব্যবসা করতে পারেনি, তাদের এক পাল্লায় মাপা ঠিক নয়।
  • ভালো ব্যবসায়ীদের সমস্যা: তিনি উল্লেখ করেন, অনেক ভালো ব্যবসায়ী কষ্ট করে টিকে থাকলেও সময়সীমা কমানোর ফলে এখন নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন এবং ঋণ পাচ্ছেন না।
  • দেউলিয়াত্ব ও বেকারত্বের শঙ্কা: ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, সতর্কতা ছাড়া ব্যাসেল-৩ হঠাৎ প্রয়োগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতে পারে। এতে দেউলিয়া ব্যবসার সংখ্যা বাড়বে, যা অর্থনীতিতে অস্থিরতা ও বেকারত্ব সৃষ্টি করতে পারে।
  • সিআইবিতে প্রভাব: সিআইবিতে (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) খেলাপি হিসেবে নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়বে। একবার তালিকাভুক্ত হলে তাদের অন্যান্য কোম্পানিও ঋণ পাবে না এবং খেলাপির ঝুঁকিতে পড়বে।
  • পুনর্বিবেচনার দাবি: আশরাফ আহমেদ সিআইবিতে খেলাপি চিহ্নিত করার নিয়ম পুনর্বিবেচনা, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ঋণ পুনর্গঠন ও সুদ মওকুফের সুযোগ এবং প্রয়োজনে দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার দাবি জানান।
  • বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর করুণ দশা: বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল ব্যাংক খাতকে আগে ঠিক করার এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় গড়ে ওঠা ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর আহ্বান জানান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে এখন একমাত্র মুনাফাকারী ব্যাংক হলো বাংলাদেশ ব্যাংক।

খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চিত্র

  • রেকর্ড খেলাপি ঋণ: দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সর্বশেষ জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ শতাংশের ওপরে বলে জানা গেছে (যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এই তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি)।
  • মার্চ প্রান্তিকের তথ্য: মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ।
  • প্রভিশন ঘাটতির ঝুঁকি: খেলাপি ঋণ বাড়লে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ডাউটফুল ও ব্যাড অ্যান্ড লস ঋণের বিপরীতে ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। অনেক ব্যাংক এখনি তা সংরক্ষণ করতে পারছে না। খেলাপি ঋণ আরও বাড়লে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকের সংখ্যা বাড়বে, যার প্রভাব বিনিয়োগকারীদের ওপর পড়বে।
  • সুদের বোঝা বৃদ্ধি: এই অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণের কারণে আগের সময়ের খেলাপিদের ঋণের বোঝাসহ বাড়তি সুদের বোঝা তুলনামূলক ভালো গ্রাহকদের ওপর চাপানো হচ্ছে।
  • সরকার পতনের সময়ের চিত্র: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, হাসিনা সরকারের পতনের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯.৯৭ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশ হয়েছে।