বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও শপথ পাঠের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর, পর্যবেক্ষণসহ লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) খারিজ করে দিয়েছেন। এই আদেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জের আইনি লড়াইয়ে সরকারের অবস্থান সুসংহত হলো।
⚖️ আইনি চ্যালেঞ্জের সূচনা ও পটভূমি
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে দেশে যে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রেক্ষাপটেই এই আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়।গত বছরের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন। এর ঠিক পরের দিন, ৬ আগস্ট, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। একইসঙ্গে তিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন বিষয়ে দেশের সাংবিধানিক পথরেখা জানতে চেয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের কাছে একটি বিশেষ রেফারেন্স (১/২৪) পাঠান।সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার নিয়ে আলোচনা করে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হয় যে আইনের এমন কোনো প্রশ্ন উঠেছে বা ওঠার সম্ভাবনা আছে যা জনগুরুত্বপূর্ণ এবং সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত প্রয়োজন, তবে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারেন। রাষ্ট্রপতির এই বিশেষ রেফারেন্সের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ দ্রুততার সঙ্গে গত বছরের ৮ আগস্ট মতামত দেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শোনার পর আপিল বিভাগ মত দেন যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার নিমিত্ত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন এবং তাদের শপথ পাঠ করাতে পারবেন।
🏛️ হাইকোর্টের রায় ও লিভ টু আপিল
আপিল বিভাগের এই মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর, এর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ গত বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটটি সরাসরি খারিজ করে দেন।হাইকোর্ট তাঁর রায়ে স্পষ্টভাবে বলেন যে, যদিও রিট আবেদনকারী দাবি করেছেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো আইনি দলিল দিয়ে সমর্থিত নয়, কিন্তু এই সরকার একটি অনন্য পরিস্থিতিতে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গৃহীত সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টামূলক মতামত এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার দ্বারা সমর্থিত। হাইকোর্ট আরও বলেন যে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুতুত্থান আমাদের ইতিহাসের অংশ। আদালত এই রিটটিকে ভ্র্রান্ত ধারণা, বিদ্বেষপ্রসূত ও হয়রানিমূলক বলে উল্লেখ করে। হাইকোর্টের এই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) রিট আবেদনকারী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ আপিল বিভাগে আবেদন করেন।
🎯 আপিল বিভাগের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি
গত মঙ্গলবার আবেদনকারী আইনজীবীর শুনানি সম্পন্ন হয়। এরপর লেখক ফিরোজ আহমেদ-এর পক্ষে ড. শরীফ ভূঁইয়া এবং আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও মোহাম্মদ শিশির মনির ইন্টারভেনার (আদালতের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তৃতীয় পক্ষ) হিসেবে শুনানিতে অংশ নেন।
দীর্ঘ শুনানির পর, বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ পর্যবেক্ষণসহ লিভ টু আপিল আবেদনটি খারিজ করে দেন। এই খারিজ আদেশের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জের আইনি প্রক্রিয়াটির যবনিকাপাত হলো। এটি নিশ্চিত হলো যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারা সমর্থিত।
এই সিদ্ধান্তের পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণের জন্য আদালতের লিখিত আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক 
























